author
stringclasses
36 values
text
stringlengths
86
1.25M
জগদীশচন্দ্র বসু
জীবনসংগ্রাম জগদীশচন্দ্র বসু জীবনসংগ্রামে যে কেবল শক্তিমানই জীবিত থাকে, দুর্বল নির্মূল হয়, এ কথা কেবল নিম্ন জীবের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য মনে করিতাম। কিন্তু পৃথিবী-ভ্রমণের ফলে এ ভ্রান্তি দূর হইয়াছে। এখন দেখিতেছি, বিশ্বব্যাপী আহবে দুর্বল উচ্ছিন্ন হইবে এবং সবল প্রতিষ্ঠিত হইবে। মনে করিবেন না যে, আমরা এখনও দূরে আছি বলিয়া এই খাণ্ডবদাহ আমাদিগকে স্পর্শ করিবে না। বহুদিন হইতেই এই ভীষণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান আরম্ভ হইয়াছে। অহিফেন সেবনে অতি সহজেই নানা কষ্ট হইতে নিজেকে উদ্ধার করিতে পারা যায়। সুতরাং অতীত গৌরব স্মরণই আমাদের পক্ষে বর্তমান দূরবস্থা ভুলিবার প্রকৃষ্ট উপায়। আর এই-যে সম্মুখে ম্যালেরিয়াতে জনপদ নির্মূল হইতেছে, দেশী শিল্প জাপানের প্রতিযোগিতায় উচ্ছিন্ন হইতেছে, এ সব কথা ভাবিতে নাই। আমাদের জড়তা সম্বন্ধে যদি আমি কোনো তীব্র ভাষা ব্যবহার করি তাহা হইলে ক্ষমা করিবেন। আমার জীবনে যদি কোনো সফলতা দেখিয়া থাকেন তবে জানিবেন, তাহা সর্বদা নিজেকে আঘাত করিয়া জাগ্রত রাখিবার ফলে। স্বপ্নের দিন চলিয়া গিয়াছে; যদি বাঁচিতে চাও তবে কশাঘাত করিয়া নিজেকে জাগ্রত রাখো। বিবিধ সংক্রামক রোগ যেন দেশকে একেবারে বিধ্বস্ত করিতে চলিল। এই সব বিপদ একেবারে অনিবার্য নয়, কিন্তু এ আমাদের অজ্ঞতা ও চেষ্টাহীনতারই বিষময় ফল। যে পুকুর হইতে পানীয় জল গৃহীত হয় তাহার অপব্যবহার সভ্যতার পরিচায়ক নহে। কি করিয়া এই সব অজ্ঞতা দূর হইতে পারে? স্কুল বৃদ্ধি অতি মন্থর গতিতে হইতেছে; আর-কোনো কি উপায় নাই যাহা দ্বারা অত্যাবশ্যক জ্ঞাতব্য বিষয় সহজে প্রচারিত হইতে পারে? আমাদের সর্বসাধারণে শিক্ষাবিস্তারের চিরন্তন প্রথা কথকতা দ্বারা। তাহা ছাড়া চক্ষে দেখিলে একটা বিষয়ে সহজেই ধারণা হয়। আমার বিবেচনায় স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় গৃহ ও পল্লী পরিষ্কার, বিশুদ্ধ জল ও বায়ুর ব্যবস্থা নির্ধারণ। এ সব বিষয় শিক্ষাবিস্তার এবং আদর্শ-গঠিত পল্লী প্রদর্শন অতি সহজেই হইতে পারে। ইহার উপায় মেলা স্থাপন। পর্যটনশীল মেলা দেশের এক প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া অল্পদিনেই অন্য প্রান্তে পৌঁছিতে পারে। এই মেলায় স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধে ছায়া চিত্রযোগে উপদেশ, স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যায়াম প্রচলন, যাত্রা, কথকতা, গ্রামের শিল্প-বস্তর সংগ্রহ, কৃষি-প্রদর্শনী ইত্যাদি গ্রামহিতকর বহুবিধ কার্য সহজেই সাধিত হইতে পারে। আমাদের কলেজের ছাত্রগণও এই উপলক্ষে তাঁহাদের দেশ পরিচর্যাবৃত্তি কার্যে পরিণত করিতে পারেন।
জগদীশচন্দ্র বসু
লোকসেবা জগদীশচন্দ্র বসু গত কয়েক বৎসর যাবৎ আমাদের দেশের ছাত্রগণ বহুবিধ রূপে লোকসেবায় আশ্চর্য পারদর্শিতা দেখাইয়াছে। ইহা দ্বারা তাহারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে। ‘পতিতের সেবা’ অথবা ‘ডিপ্রেসড্‌ মিশনে’ ও অনেকের ঐকান্তিক উৎসাহ দেখা যাইতেছে। ইহা বিশেষ শুভ লক্ষণ। এই সম্বন্ধেও কিছু ভাবিবার আছে। শৈশবকালে পিতৃদেব আমাকে বাংলা স্কুলে প্রেরণ করেন। তখন সন্তানদিগকে ইংরেজি স্কুলে প্রেরণ আভিজাত্যের লক্ষণ বলিয়া গণ্য হইত। স্কুলে দক্ষিণ দিকে আমার পিতার মুসলমান চাপরাশির পুত্র এবং বামে এক ধীবরপুত্র আমার সহচর ছিল। তাহাদের নিকট আমি পশুপক্ষী ও জলজন্তুর জীবনবৃত্তান্ত স্তব্ধ হইয়া শুনিতাম। সম্ভবতঃ প্রকৃতির কার্য অনুসন্ধানে অনুরাগ এই সব ঘটনা হইতেই আমার মনে বন্ধমূল হইয়াছিল। ছুটির পর যখন বয়স্যদের সহিত আমি ফিরিতাম তখন মাতা আমাদের আহার্য বণ্টন করিয়া দিতেন। যদিও তিনি সেকেলে এবং একান্ত নিষ্ঠাবতী ছিলেন, কিন্তু এই কার্যে যে তাঁহার নিষ্ঠার ব্যতিক্রম হয় তাহা কখনও মনে করিতেন না। ছেলেবেলায় সখ্যতা-হেতু ছোটো জাতি বলিয়া যে এক স্বতন্ত্র শ্রেণীর প্রাণী আছে এবং হিন্দুমুসলমানের মধ্যে যে এক সমস্যা আছে তাহা বুঝিতেও পারি নাই। সেদিন বাঁকুড়ায় ‘পতিত অস্পৃশ্য’ জাতির অনেকে ঘোরতর দুর্ভিক্ষে প্রপীড়িত হইতেছিল। যাঁহারা যৎসামান্য আহার্য লইয়া সাহায্য করিতে গিয়াছিলেন তাঁহারা দেখিতে পাইলেন যে, অনশনে শীর্ণ পুরুষেরা সাহায্য অস্বীকার করিয়া মুহুর্ষ স্ত্রীলোকদিগকে দেখাইয়া দিল। শিশুরাও মুষ্টিমেয় আহার্য পাইয়া তাহা দশজনের মধ্যে বণ্টন করিল। ইহার পর প্রচলিত ভাষার অর্থ করা কঠিন হইয়াছে। বাস্তবপক্ষে কাহারা পতিত, উহারা না আমরা? আর এক কথা। তুমি ও আমি যে শিক্ষালাভ করিয়া নিজেকে উন্নত করিতে পারিয়াছি এবং দেশের জন্য ভাবিবার অবকাশ পাইয়াছি, ইহা কাহার অনুগ্রহে? এই বিস্তৃত রাজ্যরক্ষার ভার প্রকৃতপক্ষে কে বহন করিতেছে? তাহা জানিতে সমৃদ্ধিশালী নগর হইতে তোমাদের দৃষ্টি অপসারিত করিয়া দুঃস্থ পল্লীগ্রামে স্থাপন করো। যেখানে দেখিতে পাইবে পঙ্কে অর্ধনিমজ্জিত, অনশনক্লিষ্ট, রোগে শীর্ণ, অস্থিচর্মসার এই ‘পতিত’ শ্রেণীরাই ধন-ধান্য দ্বারা সমগ্র জাতিকে পোষণ করিতেছে। অস্থিচূর্ণ দ্বারা নাকি ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। অস্থিচূর্ণের বোধশক্তি নাই; কিন্তু যে জীবন্ত অস্থির কথা বলিলাম, তাহার মজ্জায় চির বেদনা নিহিত আছে।
জগদীশচন্দ্র বসু
শিল্পোদ্ধার জগদীশচন্দ্র বসু সম্প্রতি এই বিষয় লইয়া অনেক আন্দোলন হইয়াছে। কেই কেহ মনে করেন যে, সরকারী একজন ডিরেক্টর নিযুক্ত হইলেই আমাদের দেশের শিল্পোদ্ধার হইবে। ডিরেক্টর মহোদয় সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান নহেন। এই সমস্ত গুণের সমন্বয়েও বিধাতাপুরুষ আমাদের দুর্গতি দূর করিতে পারেন নাই। ইহা হইতে মনে হয়, আমাদেরও কিছু কর্তব্য আছে যাহাতে আমরা একান্ত বিমুখ। জাপানে অবস্থানের কালে দেখিলাম যে, ভারতবাসী ছাত্রগণ তথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উচ্চতম স্থান অধিকার করিয়াছে। অথচ কার্যক্ষেত্রে ভারতবাসীর কোনো স্থান নাই। জাপানী কিন্তু ঐ অবস্থাতেই সিদ্ধমনোরথ না হইয়া ক্ষান্ত হয় না। সে নিজের নিষ্ফলতার কারণ অন্যের উপর ন্যস্ত করে না। আমাদের দুরবস্থার প্রকৃত কারণ কি? কারণ এই যে, চরিত্রে আমাদের বল নাই, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’ এ কথা আমরা কেবল মুখেই বলিয়া থাকি। আমি জানি যে, আমার বন্ধুদের মধ্যে কেহ কেহ স্বদেশী শিল্পের জন্য সর্বস্ব অর্পণ করিয়াছেন। বহুদিনের চেষ্টার পর তাঁহারা বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবহার্য বস্তু উৎকৃষ্টরূপে প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছেন। তথাপি তাঁহাদের ব্যবসায় যে স্থায়ী হইবে তাহার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। তাহার প্রকৃত কারণ এই যে, এ-পর্যন্ত তাঁহারা একজনও কর্মকুশল ও কর্তব্যশীল পরিচালক দেখিতে পাইলেন না। কেরানিবাবু শত শত পাওয়া যাইতেছে; তাহাদের কেবল কলমের ও মুখের জোর। বিদেশে দেখিয়াছি, ক্রোড়পতির পুত্রও ব্যবসায় শিক্ষার সময় আপিসে সর্বাপেক্ষা নিম্নতম কার্য গ্রহণ করিয়া ক্রমে ক্রমে সেখানকার সমস্ত কার্য স্বহস্তে করিয়া সম্যক্‌ শিক্ষালাভ করে। আমাদের দেশে অল্পতেই লোকের মান ক্ষয় হয়। আমাদের দেশের ছাত্র, যাহারা আমেরিকা যাইয়া সেখানকার রীতি অনুসারে কোনো কার্যহীন জ্ঞান করে নাই; এমন-কি, দারোয়ানী করিয়া এবং বাসন ধুইয়া বহু কষ্টে শিক্ষালাভ করিয়াছে, এখানে আসিয়াই তাহারা প্রকৃত মনুষ্যত্ব ভুলিয়া বিদেশীর বাহ্য ধরন-ধারণ অবলম্বন করে। তখন তাহাদের পক্ষে অনেক কার্য অপমানকর মনে হয়। এ সব সম্বন্ধে সম্প্রতি জাপান হইতে প্রত্যাগত জনৈক বন্ধুর নিকট শুনিলাম যে, সেখানে আমাদের সম্বন্ধে দুই-একটি আমোদজনক কথা চলিতেছে। তাহাদিগের অনুগ্রহ ব্যতিরেকে নাকি আমাদের গৃহিণীদের পট্টবস্ত্র হইতে হাতের চুড়ি পর্যন্ত সংগ্রহ হয় না। এখন বাঙালী বাবুদের জন্য তাহাদিগকে হুকার কল্পে পর্যন্ত প্রস্তুতের ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। এতদিন পর্যন্ত তোমরা ইউরোপের উপেক্ষা বহন করিতে অভ্যস্ত হইয়াছ, এখন হইতে এশিয়ারও হাস্যাস্পদ হইতে চলিলে! আমাদের দূর্বলতা সস্পূর্ণরূপে ত্যাগ না করিলে কোনোদিন কি শিল্পে সার্থকতা লাভ করিতে পারিব?
জগদীশচন্দ্র বসু
মানসিক শক্তির বিকাশ জগদীশচন্দ্র বসু শিল্পের উন্নতির আর-এক প্রতিবন্ধক এই যে, বিদেশে শিক্ষা করিয়া উহার ঠিক সেইমত কারখানা এ দেশের ভিন্ন অবস্থায় পরিচালন করিতে গেলে তাহা সফল হয় না। অনেক কষ্টে এবং বহু বৎসর পরে যদি বা তাহা কোনো প্রকারে কার্যকরী হয় তাহা হইলেও অতদিনে পূর্বপ্রচলিত উপায় পরিবর্তিত হইয়া যায়। পরের অনুকরণ করিতে গেলে চিরকালই এইরূপ ব্যর্থমনোরথ হইতে হইবে। কোনোদিন কি আমাদের দেশে প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের সংখ্যা বর্ধিত হইবে না, যাঁহারা কেবল শ্রুতিধর না হইয়া স্বীয় চিন্তাবলে উদ্ভাবন এবং আবিষ্কার করিতে পারিবেন? যদি ভারতকে সঞ্জীবিত রাখিতে চাও তবে তাহার মানসিক ক্ষমতাকে অপ্রতিহত রাখিতে হইবে। ভারতের সমকক্ষ প্রতিযোগী বহু প্রাচীন জাতি ধরাপৃষ্ঠ হইতে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। দেহের মৃত্যুই আমাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ নহে। ধ্বংসশীল শরীর মৃত্তিকায় মিশিয়া গেলেও জাতীয় আশা ও চিন্তা ধ্বংস হয় না। মানসিক শক্তির ধ্বংসই প্রকৃত মৃত্যু, তাহা একেবারে আশাহীন এবং চিরন্তন। তখনই আমরা জীবিত ছিলাম যখন আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানশক্তি ভারতের সীমা উল্লঙ্ঘন করিয়া দেশ-বিদেশে ব্যাপ্ত হইত। বিদেশ হইতে জ্ঞান আহরণ করিতেও তখন আমাদিগকে হীনতা স্বীকার করিতে হইত না। এখন সেদিন চলিয়া গিয়াছে, এখন কেবল আমরা পরমুখাপেক্ষী। জগতে ভিক্ষুকের স্থান নাই। কত কাল এই অপমান সহ্য করিবে? তুমি কি চিরকাল ঋণীই থাকিবে? তোমার কি কখনও দিবার শক্তি হইবে না? ভাবিয়া দেখো, এক সময়ে দেশদেশান্তর হইতে বহু জাতি তোমার নিকট শিষ্যভাবে আসিত। তক্ষশিলা, কাঞ্চী ও নালন্দার স্মৃতি কি ভুলিয়া গিয়াছ? বিক্রমপুর যে শিক্ষার এক পীঠস্থান ছিল তাহা কি স্মরণ নাই? ভারতের দান ব্যতিরেকে জগতের জ্ঞান যে অসস্পূর্ণ থাকিবে, সম্প্রতি তাহা স্বীকৃত হইয়াছে। ইহা দেবতার করুণা বলিয়া মানিতে হইবে; এই সৌভাগ্য যেন চিরস্থায়ী হয়, ইহা কি তোমাদের অভিপ্রেত নহে? তবে কোথায় সেই পরীক্ষাগার, কোথায় সেই শিষ্যবৃন্দ? এই সব আশা কি কেবল স্বপ্নমাত্রই থাকিবে? আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতেছি যে, চেষ্টার বলে অসম্ভবও সম্ভব হয়, ইহা আমি জীবন বারংবার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। অজ্ঞ হিন্দুরমণী কেবল বিশ্বাসের বলেই বহু দেবমন্দির স্থাপন করিয়াছেন। জ্ঞানমন্দির স্থাপন কি এতই অসম্ভব? মুষ্টিমেয় ভিক্ষার ফলে ভারতের বহু স্থানে বিশাল বৌদ্ধবিহার স্থাপিত হইয়াছে। অজ্ঞানই যে ভেদসৃষ্টির মূল এবং তোমাতে ও আমাতে যে কোনো পার্থক্য নাই, ইহা কেবল ভারতই সাধনা দ্বারা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই বিশাল একত্বের ভাব কি জ্ঞান ও সেবার দ্বারা জগৎকে পুনঃ প্লাবিত করিবে না? ভয় করিতেছ কি, সমস্থ জীবন দিয়াও এই অভীষ্ট লাভ করিতে পারিবে না? তোমার কি কিছুমাত্র সাহস নাই? দ্যূতক্রীড়কও সাহসে ভর করিয়া জীবনের সমস্ত ধন পণ করিয়া পাশা নিক্ষেপ করে। তোমার জীবন কি এক মহাক্রীড়ার জন্য ক্ষেপণ করিতে পার না? হয় জয় কিংবা পরাজয়!
জগদীশচন্দ্র বসু
বিফলতা জগদীশচন্দ্র বসু যদিই বা পরাজিত হইলে, যদিই বা তোমার চেষ্টা বিফল হইল, তাহা হইলেই বা কি? তবে এক বিফল জীবনের কথা শোনো- ইহা অর্ধ শতাব্দীর পূর্বের কথা। যাঁহার কথা বলিতেছি তিনি অতদিন পূর্বেও দিব্যচক্ষে দেখিয়াছিলেন যে, শিল্প, বাণিজ্য এবং কৃষি উদ্ধার না করিলে দেশের আর কোনো উপায় নাই। দেশে যখন কাপড়ের কল প্রথম স্থাপিত হয় তাহার জন্য তিনি জীবনের প্রায় সমস্ত বিসর্জন দিয়াছিলেন। যাঁহারা প্রথম পথপ্রদর্শক হন তাঁহাদের যে গতি হয়, তাঁহার তাহাই হইয়াছিল। বিবিধ নূতন উদ্যমে তিনি বহু ক্ষতিগ্রস্থ হন। কৃষকদের সুবিধার জন্য তাঁহারই প্রযত্নে সর্বপ্রথমে ফরিদপুরে লোন্‌ আপিস স্থাপিত হয়। এখানে তাঁহার সমস্ত স্বত্ব পরকে দিয়াছিলেন। এখন তাহাতে শতগুণ লাভ হইতেছে। তাঁহারই প্রযত্নে কৃষি ও শিল্পের উন্নতির জন্য ফরিদপুরে মেলা স্থাপিত হয়। তিনি আসামে স্বদেশী চা বাগান স্থাপন করেন। তাহাতেও তাঁহার অনেক ক্ষতি হইয়াছিল; কিন্তু তাঁহার অংশীদারগণ এখন বহুগুণ লাভ করিতেছেন। তিনিই প্রথমে নিজ ব্যয়ে টেক্‌নিক্যাল স্কুল স্থাপন করেন এবং তাহার পরিচালনে সর্বস্বান্ত হন। জীবনের শেষ ভাগে দেখিতে পাইলেন যে, তাঁহার সমস্ত জীবনের চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। ব্যর্থ? হয়তো একথা তাহার নিজ জীবনে প্রযোজ্য হইতে পারে; কিন্তু সেই ব্যর্থতার ফলে বহু জীবন সফল হইয়াছে। আমি আমার পিতৃদেব ভগবানচন্দ্র বসুর কথা বলিতেছিলাম। তাঁহার জীবন দেখিয়া শিখিয়াছিলাম যে, সার্থকতাই ক্ষুদ্র এবং বিফলতাই বৃহৎ। এইরূপে যখন ফল ও নিষ্ফলতার মধ্যে প্রভেদ ভুলিতে শিখিলাম, তখন হইতেই আমার প্রকৃত শিক্ষা আরম্ভ হইল। যদি আমার জীবনে কোনো সফলতা হইয়া থাকে তাহা নিষ্ফলতার স্থির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। হে বঙ্গবাসী, বর্তমান দুর্দিনের কথা এখন ভাবিয়া দেখো। তুমি কি ভুলিয়া গিয়াছ যে, অকুল জলধি এবং হিমাচল তোমাদিগকে সমগ্র পৃথিবী হইতে নিঃসম্পর্ক রাখিতে পারিবে না? তুমি কি বুঝিতে পার না যে, অতিমানুষী শক্তি ও জ্ঞানসম্পন্ন পরাক্রান্ত জাতির প্রতিযোগিতার দরুন সংঘর্ষের মধ্যে তুমি নিক্ষিপ্ত হইয়াছ? তুমি কি তোমার ক্ষীণশক্তি ও জীবন লইয়া জাতীয় জীবন চিরজীবনের মতো প্রবাহিত রাখিবে আশা করিতেছ? তুমি কি জান না যে, ধরিত্রীমাতা যেমন পাপভার বহন করতে অসমর্থ, প্রকৃতি-জননীও সেইরূপ অসমর্থ জীবনের ভার বহন করিতে বিমুখ? প্রকৃতি-মাতার এই আপাতক্রূর নির্মম প্রকৃতিতেই তাঁহার স্নেহের পরাকাষ্ঠা ব্যক্ত হইয়াছে। রুগ্ন ও দুর্বল কতকাল জীবনের যন্ত্রণা বহন করিবে? বিনাশেই তাহার শান্তি, ধ্বংসই তাহার পরিণাম। আসিরিয়া, বেবিলন, মিশর ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে! তোমার কি আছে, যার বলে তুমি জগতে চিরজীবি হইতে আকাঙ্ক্ষা কর? বোধ হয় পূর্বপিতৃগণের অর্জিত পুণ্য এখনও কিয়ৎপরিমাণে সঞ্চিত আছে; সেই পুণ্যবলেই বিধাতা তোমার অবসন্ন মস্তক হইতে তাঁহার অমোঘ বজ্র সংহত করিয়া রাখিয়াছেন। এই দেশে এখনও ভগবান তথাগতের মন্দির ও বিহারের ভগ্ন চিহ্ন স্থানে স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়। যখন ভগবান বুদ্ধদেবের সম্মুখে বহু তপস্যালব্ধ নির্বাণের দ্বার উদ্‌ঘাটিত হইল তখন সুদূর জগৎ হইতে উত্থিত জীবের কাতর ক্রন্দনধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল। সিদ্ধ পুরুষ তখন তাঁহার দুষ্কর তপস্যালব্ধ মুক্তি প্রত্যাখ্যান করিলেন। যতদিন পৃথিবীর শেষ ধূলিকণা দুঃখচক্রে পিষ্ট হইতে থাকিবে ততদিন বহুযুগ ধরিয়া তিনি তাহার দুঃখভার স্বয়ং বহন করিবেন। কথিত আছে, পঞ্চশত জন্মপরম্পরায় সুগত জীবের দুঃসহ দুঃখভার বহন করিয়াছিলেন। এইরূপে যুগে যুগে দেবোপম মহাপুরুষগণ মানবের ক্লেশভার লাঘব করিবার জন্য আবির্ভুত হইয়াছেন। সেই যুগ কি চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে? নরের দুঃখপাশ ছেদন করিবার জন্য ঈশ্বরের লীলাভূমি এই দেশে কি মহাপুরুষগণের পুনরায় আবির্ভাব হইবে না? পূর্বপিতৃগণের সঞ্চিত পুণ্যবল ও দেবতার আশীর্বাদ হইতে আমরা কি চিরতরে বঞ্চিত হইয়াছি? যখন নিশির অন্ধকার সর্বাপেক্ষা ঘোরতম তখন হইতেই প্রভাতের সূচনা। আঁধারের আবরণ ভাঙ্গিলেই আলো। কোন্‌ আবরণে আমাদের জীবন আঁধারময় ও ব্যর্থ করিয়াছে? আলস্যে, স্বার্থপরতায় এবং পরশ্রীকাতরতায়! ভাঙিয়া দাও এসব অন্ধকারের আবরণ! তোমাদের অন্তর্নিহিত আলোকরাশি উচ্ছ্বসিত হইয়া দিগ্‌দিগন্ত উজ্জ্বল করুক।
জগদীশচন্দ্র বসু
মনন ও করণ জগদীশচন্দ্র বসু পূর্বে বাংলা মাসিকপত্রে উদ্ভিদ-জীবন লইয়া যে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম, তাহাতে বলিয়াছিলাম যে, উদ্ভিদ-জীবন মানব জীবনেরই ছায়া মাত্র। সেই প্রবন্ধটি লিখিতে এক ঘন্টারও অধিক সময় লাগে নাই। কিন্তু সেই বিষয়টির কিয়দংশ মাত্র প্রতিষ্ঠা করিতে বহু বৎসর গিয়াছে। অতি সামান্য দ্রব্য গঠন করিতে অনেক চেষ্টা, অনেক অধ্যবসায়, অনেক পরিশ্রম এবং অনেক কলকারখানার আবশ্যক। কিন্তু মন কোনো বাঁধন মানে না। উচ্ছৃঙ্খল চিন্তা নিমেষে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল পরিভ্রমণ করিয়া আসে। মুহূর্তে স্বকল্পিত সত্য-মিথ্যা মিথ্যা-ঘটিত নূতন রাজ্য সৃজন করে এবং সে রাজ্য স্থাপনে যদি কেহ বাধা দেয় তাহা হইলে মানস-সম্ভব অক্ষৌহিণী সৈন্য ও অগ্নিবাণ-সাহায্যে বিপক্ষ নাশ করিয়া একাধিপত্য স্থাপন করে। কিন্তু কার্য-জগতের কথা অন্যরূপ; এখানে পদে পদে বাধা। সমস্ত জীবনের চেষ্টা দিয়াও নিজের জীবন শাসন করিতে পারিলাম না, ইহা জানিয়াও নিজের কর্তব্য ভুলিয়া পরের কর্তব্য নির্ধারণ করিবার বাসনা দূর হয় না। কঠিন পথ ত্যাগ করিয়া যাহা সহজ এবং যাহা কথা বলিয়াই নিঃশেষিত হয়, সেইদিকে ইচ্ছা স্বতঃই ধাবিত হয়। মনন ও করণ ইহার মধ্যে কত প্রভেদ! কার্যের গতি শম্বুকের গতি হইতেও মন্থর। কর্ম-রাজ্যের কঠিন পথ দিয়া মন সহজে চলিতে চাহে না। এজন্য পথ-নির্দেশকের অভাব নাই; কিন্তু পথের যাত্রী কই এই ভবের বাজারে? ‘সকল বিক্রেতা হেথা, ক্রেতা কেহ নাই।’ বঙ্গজননীকে উচ্চ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখিবার ইচ্ছা সকলেরই আছে; কিন্তু তাহার উপায় উদ্ভাবন সম্বন্ধে স্বয়ং কষ্ট স্বীকার না করিয়া পরস্পরকে কেবলমাত্র তাড়না করিলে কোনো ফল পাইব না, এ কথা বাহুল্য। এই উদ্দেশ্যে প্রধানতঃ বঙ্গ-সস্তানদের বিবিধ ক্ষেত্রে কৃতিত্ব ও তাহাদের আত্মসম্মানবোধ জাগরণ আবশ্যক; কিন্তু একথা অনেক সময় ভুলিয়া যাই। কর্মক্ষেত্রে অপরে কি পথ অবলম্বন করিবে তাহা লইয়াই কেবল আলোচনা করি। কেহ কেহ দুঃখ করিয়াছেন যে, বঙ্গের দুই একটি কৃতি সন্তান তুচ্ছ যশের মায়াতে প্রকৃষ্ট পথ ত্যাগ করিয়াছেন। সেই মায়াবশেই বাঙালী-বৈজ্ঞানিক স্বীয় আবিষ্কার বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না। যদি এই সকল তত্ত্ব কেবল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হইত তাহা হইলে বিদেশীরা অমূল্য সত্যের আকর্ষণে এদেশে আসিয়া বাংলা ভাষা শিখিতে বাধ্য হইত এবং প্রাচ্যের নিকট প্রতীচ্য মস্তক অবনত করিত। ইংরেজী ভাষায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ সম্বন্ধে ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, আমার যাহা-কিছু আবিষ্কার সম্পতি বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, তাহা সর্বাগ্রে মাতৃভাষায় প্রকাশিত হইয়াছিল এবং তাহার প্রমাণার্থ পরীক্ষা এদেশে সাধারণ-সমক্ষে প্রদর্শিত হইয়াছিল। কিন্তু আমার একান্ত দুর্ভাগ্যবশতঃ এদেশের সুধীশ্রেষ্ঠদিগের নিকট তাহা বহুদিন প্রতিষ্ঠালাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। আমাদের স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ও বিদেশের হল্-মার্কা না দেখিতে পাইলে কোনো সত্যের মূল্য সম্বন্ধে একান্ত সন্দিহান হইয়া থাকেন। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত, বাংলা ভাষায় লিখিত তত্ত্বগুলি যখন বাংলার পণ্ডিতদিগের নিকট উপেক্ষিত হইয়াছিল তখন বিদেশী ডুবুরিগণ এদেশে আসিয়া যে নদীগর্ভে পরিত্যক্ত আবর্জনার মধ্যে রত্ন উদ্ধার করিতে প্রয়াসী হইবেন, ইহা দুরাশা মাত্র। যে সকল বাধার কথা বলিলাম, তাহার পশ্চাতে যে কোনো এক অভিপ্রায় আছে তাহা এতদিনে বুঝিতে পারিয়াছি। বুঝিতে পারিয়াছি, সত্যের সম্যক্‌ প্রতিষ্ঠা প্রতিকূলতার সাহায্যেই হয়, আর আনুকুল্যের প্রশ্রয়ে সত্যের দুর্বলতা ঘটে। বৈজ্ঞানিক সত্যকে অশ্বমেধের যজ্ঞীয় অশ্বের মতো সমস্ত শত্রুরাজ্যের মধ্য দিয়া জয়ী করিয়া আনিতে না পারিলে যজ্ঞ সমাধা হয় না। এই কারণেই আমি যে সত্য-অন্বেষণ জীবনের সাধনা করিয়াছিলাম তাহা লইয়া গৌরব করা কর্তব্য মনে করি নাই; তাহাকে জীবনের সাধনা করিয়াছিলাম তাহা লইয়া গৌরব করা কর্তব্য মনে করি নাই; তাহাকে জয়ী করাই আমার লক্ষ্য ছিল। আজিকার দিনে বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরাট রণক্ষেত্র পশ্চিম দেশে প্রসারিত। পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালীর যেরূপ দুর্নাম ছিল, বিজ্ঞানক্ষেত্রেও ভারতবাসীদের সেইরূপ নিন্দা ঘোষিত হইত। তাহার বিরুদ্ধে যুঝিতে যাইয়া আমি বারংবার প্রতিহত হইয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, এ-জীবনে ব্যর্থতাই আমার সাধনার পরিণাম হইবে। কিন্তু ঘোরতর নিরাশার মধ্যেও আমি অভিভব স্বীকার করি নাই। তৃতীয়বার পশ্চিম-সমুদ্র পার হইলাম এবং বিধাতার বরে সার্থকতা লাভ করিতে পারিলাম। এই সুদীর্ঘ পরিণামে যদি জয়মাল্য আহরণ করিয়া থাকি তবে তাহা দেশ-লক্ষ্মীর চরণেই নিবেদন করিতেছি। সত্য বটে, আমাদের পূর্বপুরুষগণ যে-সকল অমর তত্ত্ব রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা দুই চারিজন বিদেশী কষ্ট স্বীকার করিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছেন। সে কারণে প্রতীচ্য বর্তমান যুগের প্রাচ্যের নিকট মস্তক অবনত করিয়াছে, এরূপ কোনো লক্ষণ দেখি না। গ্রীক এবং ইউরোপীয় সভ্যতা প্রাচীন মিশর-সভ্যতার নিকট বহু ঋণে ঋণী; কিন্তু সেই মিশর জাতীয় বংশধর ফেলাহীন আজ জগতে ঘৃণ্য। হে বেদ-উপনিষদ রচয়িতার বংশধর, হে ভারতীয় ফেলাহীন, আজ তোমার স্থান কোথায়? হায় আলনস্কর, তোমার দিবাস্বপ্ন কি কোনোদিন ভাঙিবে না? তোমার পণ্যদ্রব্য শুধু গিল্টি ও কাচ। স্বর্ণ ও হীরক বলিয়া তাহা বিক্রয় করিবে মনে করিয়াছিলে এবং অলীক ধনে আপনাকে ধনী মনে করিয়া ভাগ্যলক্ষ্মীকে পদাঘাত করিলে। দর্শকগণের উপহাস এত অল্পদিনেই ভুলিয়াছ? কি বলিতেছে? তোমার পূর্বপুরুষগণ ধনী ছিলেন, তাঁহারা পুষ্পকরথে বিমানে বিহার করিতেন! মূঢ়, তবে কি করিয়া সেই সস্পদ হারাইলে? চাহিয়া দেখো- দূরে যে ধবল পর্বত দেখিতেছ তাহা নরকঙ্কালে নির্মিত। তুমি যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া মনে কর, উহা তাহাদেরই অস্থিস্তূপ। দেখো, কাহারা সেই অস্থিনির্মিত সোপান বাহিয়া গিরিশৃঙ্গে উঠিয়াছে এবং শূন্যে ঝাঁপ দিয়া নীলাকাশে তাহাদের আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে। উড্ডীয়মান শ্যেনপক্ষীশ্রেণী বলিয়া যাহা মনে করিয়াছ, দেখিতে দেখিতে সেগুলি মেঘের অন্তরালে অন্তর্হিত হইল। অবাক হইয়া তুমি ঊর্ধ্বে চাহিয়া আছ। অকস্মাৎ মেঘরাজ্য হইতে নিক্ষিপ্ত বহ্নিশেল তোমার চতুর্দিকে পৃথিবী বিদীর্ণ করিল। কোথায় তুমি পলায়ন করিবে? গহ্বরে প্রবেশ করিয়াও নিস্তার নাই। বিষ-বাহক বাষ্পে তোমাকে সে স্থান হইতেও বাহির হইতে হইবে। কথার গ্রন্থিবন্ধনে আমরা যে জাল বিস্তার করিয়াছি, সেই জালে আপনারাও আবন্ধ হইয়াছি। সে জাল কাটিয়া বাহির হইতে হইবে। মাতৃদেবীকে অযথা সভাস্থলে আনিয়া তাঁহার অবমাননা করিও না। হৃদয়-মন্দিরেই তাঁহার প্রকৃত পীঠস্থান; জীবন-উৎসর্গই তাঁহার পূজার উপকরণ।
জগদীশচন্দ্র বসু
রানী-সন্দর্শন জগদীশচন্দ্র বসু একদিন সম্মুখের গলির মোড়ে দেখিলাম, এক ভিক্ষুক বিকট অঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া পথ-যাত্রীর করুণা উদ্রেক করিবার চেষ্টা করিতেছে। লোকটা একেবারেই ভণ্ড; প্রতারণা করিয়া সকলকে ঠকাইতেছে বলিয়া আমার রাগ হইল। এই সময় সেখান দিয়া একটি স্ত্রীলোক যাইতেছিল। তাহার পরনে ছেঁড়া কাপড়। ভিক্ষুকের কান্না শুনিয়া স্ত্রীলোকটি থমকিয়া দাঁড়াইল এবং তাহার দিকে কাতর নয়নে চাহিয়া দেখিল। তাহার অঞ্চলকোণে একটি মাত্র পয়সা বাঁধা ছিল; হয়তো তাহাই তাহার সর্বস্ব। বিনা বাক্যব্যয়ে সে সেই পয়সাটি ভিক্ষুককে দিয়া চলিয়া গেল। সেই দিনেই আমার প্রকৃত রানী-সন্দর্শন লাভ হইয়াছিল মাতৃরূপিণী জগদ্ধাত্রী রানী! এইজন্যই তো বয়স নির্বিশেষে ছোটো মেয়ে হইতে বর্ষীয়সী পর্যন্ত সকল নারীকেই আমরা মা বলিয়া সম্বোধন করি। বাঘিনী মাতৃস্নেহে মমতাপন্ন হয়। একবার ১০/১২ বৎসরের একটি ছেলে দেখিলাম। শিশুকালে নেকড়ে- বাঘিনী তাহাকে লইয়া যায়। ক্ষুধার্ত শিশু বাঘিনীর স্তন্যপান করিতে চেষ্টা করিয়াছিল; তাহাতেই তাহার প্রাণরক্ষা হইল। সেই অবধি বাঘিনী স্বীয় শাবকের ন্যায় তাহাকে পালন করিয়াছিল। কিন্তু শাবকদিগের প্রাণরক্ষার জন্য সে অন্য মূর্তি ধরিয়াছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করিয়া মরিয়াছিল। মাতৃস্নেহে দুইটি রূপ দেখা যায়; উভয়ই আশ্রিতের রক্ষা-হেতু। একটি মমতাপন্না করুণাময়ী, অন্যটি সংহাররূপিণী শক্তিময়ী। নারীর হৃদয়ের যে সন্তান-স্নেহ উত্থলিত হইয়া সমস্ত দুস্থজনকে সন্তানজ্ঞানে আগুলিয়া রাখিবে তাহা আশ্চর্য নহে। এতদ্ব্যতীত নারী স্বতঃই অভিমানিনী; প্রিয়জনের অপমান ও লাঞ্ছনা তাহাকে মর্মে মর্মে বিদ্ধ করে। হে অভিমানিনী রমণী, ভাবিয়া দেখিয়াছ কি, তুমি যাহার গৌরবে গৌরবিনী, এ জগতে তাহার স্থান কোথায়? পৃথিবী হইতে শান্তি পলায়ন করিয়াছে, সম্মুখে ঘোর দুর্দিন। যাহার উপর তুমি নির্ভর করিয়া আছ, সে কি সেই দুর্দিনে তোমাকে ঘোরতর লাঞ্ছনা হইতে রক্ষা করিতে পারিবে? বাক্য ছাড়া যে তাহার আর কোনো অস্ত্র নাই। কে তাহার বাহু সবল করিবে, হৃদয়ের শক্তি দুর্দম রাখিবে এবং মৃত্যুর বিভীষিকার অতীত করিবে? এ সকল শিক্ষা তো মাতৃ-ক্রোড়েই হইয়া থাকে। কি তোমার দীক্ষা, যাহা দিয়া তুমি সন্তানকে মানুষ করিয়া গড়িবে? কৃচ্ছসাধনা অথবা বিলাসিতা-ইহার কোন্‌ পথ তুমি গ্রহণ করিবে? রাণী হইয়া জন্মিয়াছিলে, দাসী হইয়াই কি তুমি মরিবে?
জগদীশচন্দ্র বসু
নিবেদন জগদীশচন্দ্র বসু বাইশ বৎসর পূর্বে যে স্মরণীয় ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহাতে সেদিন দেবতার করুণা জীবনে বিশেষরূপে অনুভব করিয়াছিলাম। সেদিন যে মানস করিয়াছিলাম তাহা এতদিন পরে দেবচরণে নিবেদন করিতেছি। আজ যাহা প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা মন্দির, কেবলমাত্র পরীক্ষাগার নহে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্য পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয়; কিন্তু ইন্দ্রিয়েরও অতীত দুই-একটি মহাসত্য আছে, তাহা লাভ করিতে হইলে কেবলমাত্র বিশ্বাস আশ্রয় করিতে হয়। বৈজ্ঞানিক-সত্য পরীক্ষা দ্বারা প্রতিপন্ন হয়। তাহার জন্যও অনেক সাধনার আবশ্যক। যাহা কল্পনার রাজ্যে ছিল তাহা ইন্দ্রিয়গোচর করিতে হয়। যে আলো চক্ষুর অদৃশ্য ছিল তাহাকে চক্ষুগ্রাহ্য করা আবশ্যক। শরীর-নির্মিত ইন্দ্রিয় যখন পরাস্ত হয় তখন ধাতুনির্মিত অতীন্দ্রিয়ের শরণাপন্ন হই। যে জগৎ কিয়ৎক্ষণ পূর্বে অশব্দ ও অন্ধকারময় ছিল এখন তাহার গভীর নির্ঘোষ ও দুঃসহ আলোকরাশিতে একেবারে অভিভূত হইয়া পড়ি। এই সকল একেবারে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হইলেও মনুষ্য-নির্মিত কৃত্রিম ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যাইতে পারে; কিন্তু আরও অনেক ঘটনা আছে যাহা সেই ইন্দ্রিয়েরও অগোচর, তাহা কেবল বিশ্বাসবলেই লাভ করা যায়। বিশ্বাসের সত্যতা সম্বন্ধেও পরীক্ষা আছে; তাহা দুই-একটি ঘটনার দ্বারা হয় না, তাহার প্রকৃত পরীক্ষা করিতে সমগ্র জীবনব্যাপী সাধনার আবশ্যক। সেই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই মন্দির উত্থিত হইয়া থাকে। কি সেই মহাসত্য যাহার জন্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইল? তাহা এই যে, মানুষ যখন তাহার জীবন ও আরাধনা কোনো উদ্দেশ্যে নিবেদন করে, সেই উদ্দেশ্য কখনও বিফল হয় না; তখন অসম্ভবও সম্ভব হইয়া থাকে। সাধারণের সাধুবাদ শ্রবণ আজ আমার উদ্দেশ্য নহে ; কিন্তু যাঁহারা কর্মসাগরে ঝাঁপ দিয়াছেন এবং প্রতিকূল তরঙ্গাঘাতে মৃতকল্প হইয়া অদৃষ্টের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে উদ্যত হইয়াছেন, আমার কথা বিশেষভাবে কেবল তাঁহাদেরই জন্য।
জগদীশচন্দ্র বসু
পরীক্ষা জগদীশচন্দ্র বসু যে পরীক্ষার কথা বলিব তাহা শেষ করিতে দুইটি জীবন লাগিয়াছে। যেমন একটি ক্ষুদ্র লতিকার পরীক্ষায় সমস্ত উদ্ভিদ্‌-জীবনের প্রকৃত সত্য অবিষ্কৃত হয়, সেইরূপ একটি মনুষ্যজীবনের বিশ্বাসের ফল দ্বারা বিশ্বাস-রাজ্যের সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জন্যই স্বীয় জীবনে পরীক্ষিত সত্য সম্বন্ধে যে দুই-একটি কথা বলিব তাহা ব্যক্তিগত কথা ভুলিয়া সাধারণভাবে গ্রহণ করিবেন। পরীক্ষার আরম্ভ পিতৃদেব স্বর্গীয় ভগবানচন্দ্র বসুকে লইয়া; তাহা অর্ধ শতাব্দী পূর্বের কথা। তাঁহারই নিকট আমার শিক্ষা ও দীক্ষা। তিনি শিখাইয়াছিলেন, অন্যের উপর প্রভুত্ব-বিস্তার অপেক্ষা নিজের জীবন শাসন বহুগুণে শ্রেয়স্কর। জনহিতকর নানা কার্যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে তিনি তাঁহার সকল চেষ্টা ও সর্বস্ব নিয়োজিত করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়াছিল। সুখ-সম্পদের কোমল শয্যা হইতে তাঁহাকে দারিদ্রের লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইয়াছিল। সকলেই বলিত, তিনি তাঁহার জীবন ব্যর্থ করিয়াছেন। এই ঘটনা হইতেই সফলতা কত ক্ষুদ্র এবং কোনো কোনো বিফলতা কত বৃহৎ, তাহা শিখিতে পারিয়াছিলাম। পরীক্ষার প্রথম অধ্যায় এই সময় লিখিত হইয়াছিল। তাহার পর বত্রিশ বৎসর হইল শিক্ষকতার কার্য গ্রহণ করিয়াছি। বিজ্ঞানের ইতিহাস ব্যাখ্যায় আমাকে বহু দেশবাসী মনস্বিগণের নাম স্মরণ করাইতে হইত। কিন্তু তাহার মধ্যে ভারতেই স্থান কোথায়? শিক্ষাকার্যে অন্যে যাহা বলিয়াছে সেই সকল কথাই শিখাইতে হইত। ভারতবাসীরা যে কেবল ভাবপ্রবণ ও স্বপ্নবিষ্ট, অনুসন্ধানকার্য কোনোদিনই তাহাদের নহে, সেই এক কথাই চিরদিন শুনিয়া আসিতাম। বিলাতের ন্যায় এদেশে পরীক্ষাগার নাই, সূক্ষ্ম যন্ত্র নির্মাণও এদেশে কোনোদিন হইতে পারে না, তাহাও কতবার শুনিয়াছি। তখন মনে হইল, যে ব্যক্তি পৌরুষ হারাইয়াছে কেবল সে-ই বৃথা পরিতাপ করে। অবসাদ দূর করিতে হইবে, দুর্বলতা ত্যাগ করিতে হইবে। ভারতই আমাদের কর্মভূমি, সহজ পন্থা আমাদের জন্য নহে। তেইশ বৎসর পূর্বে অদ্যকার দিনে এই সকল কথা স্মরণ করিয়া একজন তাহার সমগ্র মন, সমগ্র প্রাণ ও সাধনা ভবিষ্যতের জন্য নিবেদন করিয়াছিল। তাহার ধনবল কিছুই ছিল না, তাহার পথপ্রদর্শকও কেহ ছিল না। বহু বৎসর ধরিয়া একাকী তাহাকে প্রতিদিন প্রতিকূল অবস্থার সহিত যুঝিতে হইয়াছিল। এতদিন পরে তাহার নিবেদন সার্থক হইয়াছে।
জগদীশচন্দ্র বসু
জয়-পরাজয় জগদীশচন্দ্র বসু তেইশ বৎসর পূর্বে অদ্যকার দিনে যে আশা লইয়া কার্য আরম্ভ করিয়াছিলাম, দেবতার করুণায় তিন মাসের মধ্যে তাহার প্রথম ফল ফলিয়াছিল। জার্মানীতে আচার্য হার্টস বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্বন্ধে যে দুরূহ কার্য আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহার বহুল বিস্তার ও পরিণতি এখানেই সম্ভাবিত হইয়াছিল। কিন্তু এদেশের কোনো এক প্রসিন্ধ সভাতে আমার আবিষ্ক্রিয়ার সংবাদ যখন পাঠ করি তখন সভাস্থ কোনো সত্যই আমার কার্য সম্বন্ধে কোনো মতামত প্রকাশ করিলেন না। বুঝিতে পারিলাম, ভারতবাসীর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব সম্বন্ধে তাঁহারা একান্ত সন্দিহান। অতঃপর আমার দ্বিতীয় আবিষ্কার বর্তমান কালের সর্বপ্রধান পদার্থবিদের নিকট প্রেরণ করি। আজ বাইশ বৎসর পরে তাহার উত্তর পাইলাম। তাহাতে অবগত হইলাম যে, আমার আবিষ্ক্রিয়া রয়েল সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত হইবে এবং এই তথ্য ভবিষ্যতে বৈজ্ঞানিক উন্নতির সহায়ক হইবে বলিয়া পার্লিয়ামেন্ট কর্তৃক প্রদত্ত বৃত্তি আমার গবেষণাকার্যে নিয়োজিত হইবে। সেই দিনে ভারতের সম্মুখে যে দ্বারা অর্গলিত ছিল তাহা সহসা উম্মুক্ত হইল। আর কেহ সেই উন্মুক্ত দ্বারা রোধ করিতে পারিবে না। সেই দিন যে অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছে তাহা কখনও নির্বাপিত হইবে না। এই আশা করিয়াই আমি বৎসরের পর বৎসর অক্লান্ত মন ও শরীর লইয়া কার্যক্ষেত্রে অগ্রসর হইতেছিলাম। কিন্তু মানুষের প্রকৃত পরীক্ষা এক দিনে হয় না, সমস্ত জীবন ব্যাপিয়া তাহাকে আশা ও নৈরাশ্যের মধ্য দিয়া পুনঃ পুনঃ পরীক্ষিত হইতে হয়। যখন আমার বৈজ্ঞানিক প্রতিপত্তি আশাতীত উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিল তখনই সমস্থ জীবনের কৃতিত্ব ব্যর্থপ্রায় হইতেছিল। তখন তারহীন সংবাদ ধরিবার কল নির্মাণ করিয়া পরীক্ষা করিতেছিলাম। দেখিলাম, হঠাৎ কলের সাড়া কোনো অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হইয়া গেল। মানুষের লেখাভঙ্গী হইতে তাহার শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি যেরূপ অনুমান করা যায়, কলের সাড়ালিপিতে সেই একই রূপ চিহ্ন দেখিলাম। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে. বিশ্রামের পর কলের ক্লান্তি দূর হইল এবং পুনরায় সাড়া দিতে লাগিল। উত্তেজক ঔষধ প্রয়োগে তাহার সাড়া দিবার শক্তি বাড়িয়া গেল এবং বিষ প্রয়োগে তাহার সাড়া একেবারে অন্তর্হিত হইল। যে সাড়া দিবার শক্তি জীবনের এক প্রধান চিহ্ন বলিয়া গণ্য হইত, জড়েও তাহার ক্রিয়া দেখিতে পাইলাম। এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা আমি রয়েল সোসাইটি সমক্ষে পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রচলিত মত-বিরুদ্ধ বলিয়া জীবতত্ত্ববিদ্যার দুই-একজন অগ্রণী ইহাতে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। তদ্ভিন্ন আমি পদার্থবিৎ, আমার স্বীয় গণ্ডি ত্যাগ করিয়া জীবতত্ত্ববিদের নূতন জাতিতে প্রবেশ করিবার অনধিকার চেষ্টা রীতিবিরুদ্ধ বলিয়া বিবেচিত হইল। তাহার পর আরও দুই-একটি অশোভন ঘটনা ঘটিয়াছিল। যাঁহারা আমার বিরুদ্ধপক্ষে ছিলেন তাঁহাদেরই মধ্যে একজন আমার আবিষ্কার পরে নিজের বলিয়া প্রকাশ করেন। এই বিষয়ে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন। ফলে, বহু বৎসর যাবৎ আমার সমুদয় কার্য পণ্ডপ্রায় হইয়াছিল। এতকাল একদিনের জন্যও মেষরাশি ভেদ করিয়া আলোকের মুখ দেখিতে পাই নাই। এই সকল স্মৃতি অতিশয় ক্লেশকর। বলিবার একমাত্র আবশ্যকতা এই যে, যদি কেহ কোনো বৃহৎ কার্যে জীবন উৎসর্গ করিতে উন্মুখ হন, তিনি যেন ফলাফলে নিরপেক্ষ হইয়া থাকেন। যদি অসীম ধৈর্য থাকে, কেবল তাহা হইলেই বিশ্বাস-নয়নে কোনোদিন দেখিতে পাইবেন, বারংবার পরাজিত হইয়াও যে পরাঙ্মুখ হয় নাই সে-ই একদিন বিজয়ী হইবে।
জগদীশচন্দ্র বসু
পৃথিবী পর্যটন জগদীশচন্দ্র বসু ভাগ্য ও কার্যচক্র নিরন্তর ঘুরিতেছে- তাহার নিয়ম-উত্থান, পতন, আবার পুনরুত্থান। দ্বাদশ বৎসর ধরিয়া যে ঘন দুর্দিন আমাকে ম্রিয়মাণ করিয়াও সম্পূর্ণ পরাভব করিতে পারে নাই, সে দুর্যোগও একদিন অভাবনীয়রূপে কাটিয়া গেল। আমার নূতন আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রচার করিবার জন্য ভারত-গভর্নমেন্ট ১৯১৪ খৃস্টাব্দে আমাকে পৃথিবী পর্যটনে প্রেরণ করেন। সেই উপলক্ষে লণ্ডন, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, প্যারিস, ভিয়েনা, হার্ভার্ড, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, ফিলাডেলফিয়া, সিকাগো, কালিফোর্নিয়া, টোকিও ইত্যাদি স্থানে আমার পরীক্ষা প্রদর্শিত হয়। এই সকল স্থানে জয়মাল্য লইয়া কেহ আমার প্রতীক্ষা করে নাই, বরং আমার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিগণ আমার ত্রুটি দেখাইবার জন্যই দলবদ্ধ হইয়া উপস্থিত ছিলেন। তখন আমি সম্পূর্ণ একাকী; অদৃশ্যে কেবল সহায় ছিলেন ভারতের ভাগ্যলক্ষ্মী। এই অসম সংগ্রামে ভারতেরই জয় হইল এবং যাঁহারা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাঁহারা পরে আমার পরম বান্ধব হইলেন।
জগদীশচন্দ্র বসু
বীরনীতি জগদীশচন্দ্র বসু বর্তমান উদ্ভিদবিদ্যার অসীম উন্নতি লাইপজিগের জার্মান অধ্যাপক ফেফারের অর্থ শতাব্দীর অসাধারণ কৃতিত্বের ফল। আমার কোনো কোনো আবিষ্ক্রিয়া ফেফারের কয়েকটি মনের বিরুদ্ধে। তাঁহার অসন্তোষ উৎপাদন করিয়াছি মনে করিয়া আমি লাইপজিগ না গিয়া ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। সেখানে ফেফার তাঁহার সহযোগী অধ্যাপককে আমায় নিমন্ত্রণ করিবার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি বলিয়া পাঠাইলেন যে, আমার প্রতিষ্ঠিত নূতন তত্ত্বগুলি জীবনের সন্ধ্যার সময় তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছেন; তাঁহার দুঃখ রহিল যে, এই সকল সত্যের পরিণতি তিনি এ-জীবনে দেখিয়া যাইতে পারিলেন না। যাঁহার বৈরীভাব আশঙ্কা করিয়াছিলাম, তিনিই মিত্ররূপে আমাকে গ্রহণ করিলেন। ইহাই তো চিরন্তন বীরনীতি, যাহা আপনার পরাভবের মধ্যেও সত্যের জয় দেখিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হয়। তিন সহস্র বৎসর পূর্বে এই বীরধর্ম কুরুক্ষেত্রে প্রচারিত হইয়াছিল। অগ্নিবাণ আসিয়া যখন ভীষ্মদেবের মর্মস্থান বিদ্ধ করিল তখন তিনি আনন্দের আবেগে বলিয়াছিলেন, সার্থক আমার শিক্ষাদান! এই বাণ শিখণ্ডীর নহে, ইহা আমার প্রিয়শিষ্য অর্জুনের। পৃথিবী পর্যটন ও স্বীয় জীবনের পরীক্ষার দ্বারা বুঝিতে পারিয়াছি যে, নূতন সত্য আবিষ্কার করিবার জন্য সমস্থ জীবন পণ ও সাধনার আবশ্যক। জগতে তাহার প্রচার আরও দুরূহ। ইহাতে আমার পূর্বসংকল্প দৃঢ়তর হইয়াছে। বহুদিন সংগ্রামের পর ভারত বিজ্ঞানক্ষেত্রে যে স্থান অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছে তাহা যেন চিরস্থায়ী হয়। আমার কার্য যাঁহার অনুসরণ করিবেন তাঁহাদের পথ যেন কোনোদিন অবরুদ্ধ না হয়!
জগদীশচন্দ্র বসু
বিজ্ঞান-প্রচারে ভারতের দান জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান তো সার্বভৌমিক, তবে বিজ্ঞানের মহাক্ষেত্রে এমন-কি কোনো স্থান আছে যাহা ভারতীয় সাধক ব্যতীত অসম্পূর্ণ থাকিবে? তাহা নিশ্চয়ই আছে। বর্তমানকালে বিজ্ঞানের প্রসার বহুবিস্তৃত হইয়াছে এবং প্রতীচ্যদেশে কার্যের সুবিধার জন্য তাহা বহুধা বিভক্ত হইয়াছে এবং বিভিন্ন শাখার মধ্যে অভেদ্য প্রাচীর উত্থিত হইয়াছে। দৃশ্যজগৎ অতি বিচিত্র এবং বহুরূপী এত বিভিন্নতার মধ্যে যে কিছু সাম্য আছে তাহা বোধগম্য হয় না। সতত চঞ্চল প্রাণী, আর এই চিরমৌন অবিচলিত উদ্ভিদ, ইহাদের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য দেখা যায় না। আর এই উদ্ভিদের মধ্যে একই কারণে বিভিন্নরূপে সাড়া দেখা যায়। কিন্তু এত বৈষম্যের মধ্যেও ভারতীয় চিন্তাপ্রণালী একতার সন্ধানে ছুটিয়া জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে সেতু বাঁধিয়াছে। এতদর্থে ভারতীয় সাধক কখনও তাহার চিন্তা কল্পনার উম্মুক্ত রাজ্যে অবাধে প্রেরণ করিয়াছে এবং পরমুহূর্তের তাহাকে শাসনের অধীনে আনিয়াছে। আদেশের বলে জড়বৎ অঙ্গুলিতে নূতন প্রাণ সঞ্চার করিয়াছে এবং যে স্থলে মানুষের ইন্দ্রিয় পরাস্ত হইয়াছে তথায় কৃত্রিম অতীন্দ্রিয় সৃজন করিয়াছে। তাহা দিয়া এবং অসীম ধৈর্য সম্বল করিয়া অব্যক্ত জগতের সীমাহীন রহস্যের পরীক্ষা প্রণালীতে স্থির প্রতিষ্ঠা করিবার সাহস বাঁধিয়াছে। যাহা চক্ষুর অগোচর ছিল তাহা দৃষ্টিগোচর করিয়াছে। কৃত্রিম চক্ষু পরীক্ষা করিয়া মানুষ্যদৃষ্টির অভাবনীয় এমন এক নূতন রহস্য আবিষ্কার করিয়াছে যে, তাহার দুইটি চক্ষু এক সময়ে জাগরিত থাকে না; পর্যায়ক্রমে একটি ঘুমায়, আর-একটি জাগিয়া থাকে। ধাতুপাত্রে লুক্কায়িত স্মৃতির অদৃশ্য ছাপ প্রকাশিত করিয়া দেখাইয়াছে। অদৃশ্য-আলোক সাহায্যে কৃষ্ণপ্রস্তরের ভিতরের নির্মাণকৌশল বাহির করিয়াছে। আণবিক কারুকার্য ঘূর্ণ্যমান বিদ্যুৎ-ঊর্মির দ্বারা দেখাইয়াছে। বৃক্ষজীবন মানবীয় জীবনের প্রতিকৃতি দেখাইয়া নির্বাক জীবনের উত্তেজনা মানবের অনুভূতির অন্তর্গত করিয়াছে। বৃক্ষের অদৃশ্য বৃদ্ধি মাপিয়া লইয়াছে এবং বিভিন্ন আহার ও ব্যবহারে সেই বৃদ্ধিমাত্রার পরিবর্তন মুহূর্তে ধরিয়াছে। মনুষ্যস্পর্শেও যে বৃক্ষ সংকুচিত হয়, তাহা প্রমাণ করিয়াছে। যে উত্তেজক মানুষকে উৎফুল্ল করে, যে মাদক তাহাকে অবসন্ন করে, যে বিষ তাহার প্রাণনাশ করে, উদ্ভিদেও তাহাদের একই বিধ ক্রিয়া প্রমাণিত করিতে সমর্থ হইয়াছে। বিষে অবসন্ন মুমূর্ষু উদ্ভিদকে ভিন্ন বিষ প্রয়োগ দ্বারা পুনজীবিত করিয়াছে। উদ্ভিদপেশীর স্পন্দন লিপিবদ্ধ করিয়া তাহাতে হৃদয়স্পন্দনের প্রতিচ্ছায়া দেখাইয়াছে। বৃক্ষশরীর স্নায়ুপ্রবাহ আবিষ্কার করিয়া তাহার বেগ নির্ণয় করিয়াছে। প্রমাণ করিয়াছে যে, যে সকল কারণে মানুষের স্নায়ুর উত্তেজনা বর্ধিত বা মন্দীভূত হয় সেই একই কারণে উদ্ভিদ-স্নায়ুর আবেগও উত্তেজিত অথবা প্রশমিত হয়। এই সকল কথা কল্পনাপ্রসূত নহে। যে সকল অনুসন্ধান আমার পরীক্ষাগারে গত তেইশ বৎসর ধরিয়া পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত হইয়াছে ইহা তাহারই অতি সংক্ষিপ্ত ও অপরিপূর্ণ ইতিহাস। যে সকল অনুসন্ধানের কথা বলিলাম তাহাতে নানাপথ দিয়া পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, এমন-কি মনস্তত্ত্ববিদ্যাও এক কেন্দ্রে আসিয়া মিলিত হইয়াছে। বিধাতা যদি বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ তীর্থ ভারতীয় সাধকের জন্য নির্দেশ করিয়া থাকেন তবে এই চতুর্বেণী-সংগমেই সেই মহাতীর্থ।
জগদীশচন্দ্র বসু
আশা ও বিশ্বাস জগদীশচন্দ্র বসু এই সকল অনুসন্ধান বিজ্ঞানের বহু শাখা লইয়া। কেহ কেহ মনে করেন, ইহাদের বিকাশে নানা ব্যবহারিক বিদ্যার উন্নতি এবং জগতের কল্যাণ সাধিত হইবে। যে-সকল আশা ও বিশ্বাস লইয়া আমি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা কি একজনের জীবনের সঙ্গেই সমাপ্ত হইবে? একটিমাত্র বিষয়ের জন্য বীক্ষণাগার নির্মাণে অপরিমিত ধনের আবশ্যক হয়; আর এইরূপ অতি বিস্তৃত এবং বহুমুখী জ্ঞানের বিস্তার যে আমাদের দেশের পক্ষে অসম্ভব, একথা বিজ্ঞজন মাত্রেই বলিবেন। কিন্তু আমি অসম্ভাব্য বিষয়ের উপলক্ষে কেবলমাত্র বিশ্বাসের বলেই চিরজীবন চলিয়াছি; ইহা তাহারই মধ্যে অন্যতম। ‘হইতে পারে না’ বলিয়া কোনোদিন পরাঙ্মুখ হই নাই; এখনও হইব না। আমার যাহা নিজস্ব বলিয়া মনে করিয়াছিলাম তাহা এই কার্যেই নিয়োগ করিব। রিক্তহস্তে আসিয়াছিলাম, রিক্তহস্তেই ফিরিয়া যাইব; ইতিমধ্যে যদি কিছু সম্পাদিত হয় তাহা দেবতার প্রসাদ বলিয়া মানিব। আর একজনও এই কার্যে তাঁহার সর্বস্ব নিয়োগ করিবেন, যাঁহার সাহচর্য আমার দুঃখ এবং পরাজয়ের মধ্যেও বহুদিন অটল রহিয়াছে। বিধাতার করুণা হইতে কোনোদিন একেবারে বঞ্চিত হই নাই। যখন আমার বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বে অনেকে সন্দিহান ছিলেন তখনও দুই-এক জনের বিশ্বাস বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছিল। আজ তাঁহারা মৃত্যুর পরপারে। আশঙ্কা হইয়াছিল, কেবলমাত্র ভবিষ্যতের অনিশ্চিত বিধানের উপরেই এই মন্দিরের স্থায়িত্ব নির্ভর করিবে। অল্পদিন হইল বুঝিতে পারিয়াছি যে, আমি যে আশায় কার্য আরম্ভ করিয়াছি তাহার আহ্বান ভারতের দূরস্থানেও মর্ম স্পর্শ করিয়াছে। এই সকল দেখিয়া মনে হয়, আমি যে বৃহৎ সংকল্প করিয়াছিলাম তাহার পরিণতি একেবারে অসম্ভব নহে। জীবিত থাকিতেই হয়তো দেখিতে পাইব যে, এই মন্দিরের শূন্য অঙ্গন দেশবিদেশ হইতে সমাগত যাত্রী দ্বারা পূর্ণ হইয়াছে।
জগদীশচন্দ্র বসু
আবিষ্কার এবং প্রচার জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান অনুশীলনের দুইটি দিক আছে। প্রথমত নূতন তত্ত্ব আবিষ্কার; ইহার এই মন্দিরের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাহার পর, জগতে সেই নূতন তত্ত্ব প্রচার। সেইজন্যই এই সুবৃহৎ বক্তৃতাগৃহ নির্মিত হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা ও তাহার পরীক্ষার জন্য এইরূপ গৃহ বোধ হয় অন্য কোথাও নির্মিত হয় নাই। দেড় সহস্র শ্রোতার এখানে সমাবেশ হইতে পারিবে। এস্থানে কোনো বহুচর্বিত তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি হইবে না। বিজ্ঞান সম্বন্ধে এই মন্দিরে যে সকল আবিষ্ক্রিয়া হইয়াছে সেই সকল নূতন সত্য এস্থানে পরীক্ষা সহকারে সর্বাগ্রে প্রচারিত হইবে। সর্বজাতির সকল নরনারীর জন্য এই মন্দিরের দ্বার চিরদিন উম্মুক্ত থাকিবে। মন্দির হইতে প্রচারিত পত্রিকা দ্বারা নব নব প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জগতে পণ্ডিতমণ্ডলীর নিকট বিজ্ঞাপিত হইবে এবং হয়তো তদ্‌দ্বারা ব্যবহারিক বিজ্ঞানেরও উন্নতি সাধিত হইবে। আমার আরও অভিপ্রায় এই যে, এ মন্দিরের শিক্ষা হইতে বিদেশবাসীও বঞ্চিত হইবে না। বহুশতাব্দী পূর্বে ভারতে জ্ঞান সার্বভৌমিকরূপে প্রচারিত হইয়াছিল। এই দেশে নালন্দা এবং তক্ষশিলায় দেশদেশান্তর হইতে আগত শিক্ষার্থী সাদরে গৃহীত হইয়াছিল। যখনই আমাদের দিবার শক্তি জন্মিয়াছে তখনই আমরা মহৎরূপে দান করিয়াছি- ক্ষুদ্রে কখনই আমাদের তৃপ্তি নাই। সর্বজীবনের স্পর্শে আমাদের জীবন প্রাণময়। যাহা সত্য, যাহা সুন্দর, তাহাই আমাদের আরাধ্য। শিল্পী কারুকার্যে এই মন্দির মণ্ডিত করিয়াছেন এবং চিত্রকর আমাদের হৃদয়ের অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা চিত্রপটে বিকশিত করিয়াছেন। আমি যে উদ্ভিদ-জীবনের কথা বলিয়াছি তাহা আমাদের জীবনেরই প্রতিধ্বনি। সে জীবন আহত হইয়া মুমূর্ষু প্রায় হয় এবং ক্ষণিক মূর্ছা হইতে পুনরায় জাগিয়া উঠে। এই আঘাতের দুইটি দিক আছে; আমরা সেই দুইয়ের সংযোগস্থলে বর্তমান। এক দিকে জীবনের, অপর দিকে মৃত্যুর পথ প্রসারিত। জীবের স্পন্দন আঘাতেরই ক্রিয়া, যে আঘাত হইতে আমরা পুনরায় উঠিতে পারি। প্রতি মুহূর্তে আমরা আঘাত দ্বারা মুমূর্ষু হইতেছি এবং পুনরায় সঞ্জীবিত হইতেছি। আঘাতের বলেই জীবনের শক্তি বর্ধিত হইতেছে। তিল তিল করিয়া মরিতেছি বলিয়াই আমরা বাঁচিয়া রহিয়াছি। একদিন আসিবে যখন আঘাতের মাত্রা ভীষণ হইবে; তখন যাহা হেলিয়া পড়িবে তাহা আর উঠিবে না; অন্য কেহও তাহাকে তুলিয়া ধরিতে পারিবে না। ব্যর্থ তখন স্বজনের ক্রন্দন, ব্যর্থ তখন সতীর জীবনব্যাপী ব্রত ও সাধনা। কিন্তু যে মৃত্যুর স্পর্শে সমুদয় উৎকন্ঠা ও চাঞ্চল্য শান্ত হয় তাহার রাজত্ব কোন কোন দেশ লইয়া? কে ইহার রহস্য উদঘাটন করিবে? অজ্ঞান-তিমিরে আমরা একেবারে আচ্ছন্ন। চক্ষুর আবরণ অপসারিত হইলেই এই ক্ষুদ্র বিশ্বের পশ্চাতে অচিন্তনীয় নূতন বিশ্বের অনন্ত ব্যাপ্তিতে আমরা অভিভূত হইয়া পড়ি। কে মনে করিতে পারিত, এই আর্তনাদবিহীন উদ্ভিদজগতে, এই তুষ্ণীম্ভুত অসীম জীবসঞ্চারে অনুভুতিশক্তি বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। তাহার পর কি করিয়াই বা স্নায়ুসূত্রের উত্তেজনা হইতে তাহারই ছায়ারূপিণী অশরীরী স্নেহমমতা উদ্ভূত হইল! ইহার মধ্যে কোন্‌টা অজর, কোন্‌টা অমর? যখন এই ক্রীড়াশীল পুত্তলিদের খেলা শেষ হইবে এবং তাহাদের দেহাবশেষ পঞ্চভূতে মিশিয়া যাইবে তখন সেই সকল-অশরীরী ছায়া কি আকাশে মিলাইয়া যাইবে, অথবা অধিকতররূপে পরিস্ফুট হইবে? কোন্‌ রাজ্যের উপর তবে মৃত্যুর অধিকার? মৃত্যুই যদি মনুষ্যের একমাত্র পরিণাম তবে ধনধান্যে পূর্ণা পৃথিবী লইয়া সে কী করিবে? কিন্তু মৃত্যু সর্বজয়ী নহে; জড়-সমষ্টির উপরই কেবল তাহার আধিপত্য। মানব-চিন্তাপ্রসূত স্বর্গীয় অগ্নি মৃত্যুর আঘাতেও নির্বাপিত হয় না। অমরত্বের বীজ চিন্তায়, বিত্তে নহে। মহাসাম্রাজ্য দেশ-বিজয়ে কোনোদিন স্থাপিত হয় নাই। তাহার প্রতিষ্ঠা কেবল চিন্তা ও দিব্যজ্ঞান প্রচার দ্বারা সাধিত হইয়াছে। বাইশ শত বৎসর পূর্বে এই ভারতখণ্ডেই অশোক যে মহাসাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন তাহা কেবল শারীরিক বল ও পার্থিব ঐশ্বর্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। সেই মহাসাম্রাজ্যে যাহা সঞ্চিত হইয়াছিল তাহা কেবল বিতরণের জন্য, এবং জীবের কল্যাণের জন্য। জগতের মুক্তি-হেতু সমস্ত বিতরণ করিয়া এমন দিন আসিল যখন সেই সসাগরা ধরণীর অধিপতি অশোকের অর্থ আমলক মাত্র অবশিষ্ট রহিল। তখন তাহা হস্তে লইয়া তিনি কহিলেন- এখন ইহাই আমার সর্বস্ব, ইহাই যেন আমার চরম দানরূপে গৃহিত হয়।
জগদীশচন্দ্র বসু
৫২. অর্ঘ্য জগদীশচন্দ্র বসু এই আমলকের চিহ্ন মন্দিরগাত্রে গ্রথিত রহিয়াছে। পতাকাস্বরূপ সর্বোপরি বজ্রচিহ্ন প্রতিষ্ঠিত- যে দৈবঅস্ত্র নিষ্পাপ দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা নির্মিত হইয়াছিল। যাঁহারা পরার্থে জীবন দান করেন তাঁহাদের অস্থি দ্বারাই বজ্র নির্মিত হয়, যাহার জ্বলন্ত তেজে জগতে দানবত্বের বিনাশ ও দেবত্বের প্রতিষ্ঠা হইয়া থাকে। আজ আমাদের অর্ঘ্য অর্ধ আমলক মাত্র; কিন্তু পূর্বদিনের মহিমা মহত্তর হইয়া পুনর্জন্ম লাভ করিবেই করিবে। এই আশা লইয়া অদ্য আমরা ক্ষণকালের জন্য এখানে দাঁড়াইলাম কল্য হইতে পুনরায় কর্মস্রোতে জীবনতরী ভাসাইব। আজ কেবল আরাধ্যা দেবীর পূজার অর্ঘ্য লইয়া এখানে আসিয়াছি। তাঁহার প্রকৃত স্থান বাহিরে নহে, হৃদয়মন্দিরে। তাঁহার প্রকৃত উপকরণ ভক্তের বাহুবলে, অন্তরের শক্তিতে এবং হৃদয়ের ভক্তিতে। তাহার পর সাধক কি আশীর্বাদ আকাঙ্ক্ষা করিবে? যখন প্রদীপ্ত জীবন নিবেদন করিয়াও তাহার সাধনার সমাপ্তি হইবে না, যখন পরাজিত ও মুমূর্ষ হইয়া সে মৃত্যুর অপেক্ষা করিবে, তখনই আরাধ্যা দেবী তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইবেন। এইরূপ পরাজয়ের মধ্য দিয়াই সে তাহার পুরস্কার লাভ করিবে।
জগদীশচন্দ্র বসু
দীক্ষা জগদীশচন্দ্র বসু আমরা সকলেই শিক্ষার্থী, কার্যক্ষেত্রে প্রত্যহই শিখিতেছি, দিন দিন অগ্রসর হইতেছি এবং বাড়িতেছি। জীবন সম্বন্ধে একটি মহাসত্য এই যে, যেদিন হইতে আমাদের বাড়ীবার ইচ্ছা স্থগিত হয় সেই দিন হইতেই জীবনের উপর মৃত্যুর ছায়া পড়ে। জাতীয় জীবন সম্বন্ধে একই কথা। যেদিন হইতে আমাদের বড়ো হইবার ইচ্ছা থামিয়াছে সেদিন হইতেই আমাদের পতনের সূত্রপাত হইয়াছে। আমাদিগকে বাঁচিতে হইবে, সঞ্চয় করিতে হইবে এবং বাড়িতে হইবে। তাহার জন্য কি করিয়া প্রকৃত, ঐশ্বর্য লাভ হইতে পারে একাগ্রচিত্তে সেই দিকে লক্ষ্য রাখিবে। দ্রোণাচার্য শিষ্যগণের পরীক্ষার্থ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘গাছের উপর যে পাখিটি বসিয়া আছে তাহার চক্ষুই লক্ষ্য; পাখিটি কি দেখিতে পাইতেছ?’ অর্জুন উত্তর করিলেন, ‘না, পাখি দেখিতে পাইতেছি না, কেবল তাহার চক্ষুমাত্র দেখিতেছি।’ এইরূপ একাগ্রচিত্তে হইলেই বাহিরের বাধা-বিঘ্নের মধ্যেও অবিচলিত থাকিয়া লক্ষ্য ভেদ করিতে সমর্থ হইবে। তবে সেই লক্ষ্য কি? লক্ষ্য, শক্তি সঞ্চয় করা, যাহা দ্বারা অসাধ্যও সাধিত হয়। জীবন সম্বন্ধে পরীক্ষা করিয়া দেখা যায় যে, শক্তি সঞ্চয় দ্বারাই জীবন পরিস্ফুটিত হয়। তাহা কেবল নিজের একাগ্র চেষ্টা দ্বারাই সাধিত হইয়া থাকে। যে কোনোরূপ সঞ্চয় করে না, যে পরমুখাপেক্ষী, যে ভিক্ষুক, সে জীবন হইয়াও মরিয়া আছে। যে সঞ্চয় করিয়াছে সেই-ই শক্তিমান, সেই-ই তাহার সঞ্চিত ধন বিতরণ করিয়া পৃথিবীকে সমৃদ্ধিশালী করিবে। কে এই সাধনার পথ ধরিবে? এজন্য কেবল অল্প কয়জনকেই আহ্বান করিতেছি। দুই-এক বৎসরের জন্য নহে; সমস্ত জীবনব্যাপী সাধনার জন্য। দেখিতেছ না ধুলিকণার ন্যায়, কীটের ন্যায় নিয়ত কত জীবন পেষিত হইতেছে। ভীষণ জীবনচক্রের গতি দেখিয়া ভীত হইয়াছ? স্বভাবের নির্মম ও কাণ্ডারীহীন কার্য-কারণ সম্বন্ধ বুঝিতে না পারিয়া ম্রিয়মান হইয়াছে? কিন্তু তোমাদেরই অন্তরে দৈব দৃষ্টি আছে, তাহা উজ্জ্বল করো। হয়তো প্রকৃতির মধ্যে একটা দিশা, একটা উদ্দেশ্য দেখিতে পাইবে। দেখিতে পাইবে যে, এই বিশ্ব জীবন্ত, জড়পিণ্ড মাত্র নহে। তাহার আহার উল্কাপিণ্ড, তাহার শিরায় শিরায় গলিত ধাতুর স্রোত প্রবাহিত হইতেছে। সামান্য ধূলিকণাও বিনষ্ট হয় না, ক্ষুদ্র শক্তিও বিনাশ পায় না; জীবনও হয়তো তবে অবিনশ্বর। মানসিক শক্তিতেই জীবনের চরমোচ্ছ্বাস। দেখ, তাহারই বলে এই পুণ্য দেশ সঞ্জীবিত রহিয়াছে। সেবা দ্বারা, ভক্তি দ্বারা, জ্ঞান দ্বারা মানুষ একই স্থানে উপনীত হয়। তোমরাও তাহার একটি পথ গ্রহণ করো। জীবন ও তাহার পরিণাম, এই জগৎ ও অপর জগৎ তোমাদের সাধনার লক্ষ্য হউক। নির্ভীক বীরের ন্যায় জীবনকে মহাহবে নিক্ষেপ করো।
জগদীশচন্দ্র বসু
আহত উদ্ভিদ জগদীশচন্দ্র বসু পশ্চিমে কয় বৎসর যাবৎ আকাশ ধূমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দৃষ্টি পৌঁছিত না। অপরিস্পুট আর্তনাদ কামানের গর্জনে পরাহত। কিন্তু যেদিন হইতে শিখ ও পাঠান, গুরখা ও বাঙালী সেই মহারণে জীবন আহুতি দিতে গিয়াছে, সেদিন হইতে আমাদের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি বাড়িয়া গিয়াছে। শুভ্র তুষার-প্রান্তর যাহাদের জীবনধারায় রক্তিম হইয়াছে তাহাদের অন্তিম বেদনা আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিতেছে। কি এই আকর্ষণ যাহা সকল ব্যবধান ঘুচাইয়া দেয়, যাহা নিকটকেও নিকটতর করে, যাহাতে পর ও আপন ভুলিয়া যাই? সমবেদনাই সেই আকর্ষণ, কেবল সহানুভূতি-শক্তিতেই আমাদের জীবন প্রকৃত সত্য প্রতিভাত হয়। চিরসহিষ্ণু এই উদ্ভিদরাজ্য নিশ্চলভাবে আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান। উত্তাপ ও শৈত্য, আলো ও অন্ধকার, মৃদু সমীরণ ও ঝটিকা, জীবন ও মৃত্যু ইহাদিগকে লইয়া ক্রীড়া করিতেছে। বিবিধ শক্তি দ্বারা ইহারা আহত হইতেছে, কিন্তু আহতের কোনো ক্রন্দনধ্বনি উত্থিত হইতেছে না। এই অতি সংযত, মৌন ও অক্রন্দিত জীবনেরও যে এক মর্মভেদী ইতিহাস আছে তাহা বর্ণনা করিব। মানুষকে আঘাত করিলে সে চীৎকার করে। তাহা হইতে মনে করি, সে বেদনা পাইয়াছে। বোবা চীৎকার করা না; কি করিয়া জানিব, সে বেদনা পাইয়াছে? সে ছট্‌ফট্ করে, তাহার হস্তপদ আকুঞ্চিত হয়; দেখিয়া মনে হয়, সেও বেদনা পাইয়াছে। সমবেদনার দ্বারা তাহার কষ্ট অনুভব করি। ব্যাঙকে আঘাত করিলে সে চিৎকার করে না, কিন্তু ছট্‌ফট করে; তবে মানুষ ও ব্যাঙ যে অনেক প্রভেদ! ব্যাঙ বেদনা পাইল কি না, এ কথা কেবল অন্তর্যামীই জানেন। সমবেদনা সতত ঊর্ধ্বমুখী, কখনও কখনও সমতলগামী, কৃচিৎ নিম্নগামী। ইতর লোক যে আমাদের মতোই সুখ দুঃখ, মান অপমান বোধ করে, এ কথা কেহ কেহ সন্দেহ করিয়া থাকেন। ইতর জীবের তো কথাই নাই। তবে ব্যাঙ আঘাত পাইয়া যে কিছু-একটা অনুভব করে এবং সাড়া দেয়, এ কথা মানিয়া লইতেই হইবে। অনুভব করে- এই কথা, টের পায় এই অর্থে ব্যবহার করিব। মানুষ বেদনা পায়, ইতর জীব সাড়া দেয়, এই কথাতে কেহ কোন আপত্তি করিবেন না। ব্যাঙের ছট্‌ফটানি দেখিয়া হয়তো অভ্যাস-দোষে কখনও বলিয়া ফেলিতে পারি যে, সে বেদনা পাইয়াছে। এ কথাটা রূপক অর্থে লইবেন। কথা ব্যবহার সম্বন্ধে সাবধান হওয়া আবশ্যক। কারণ বিলাতের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত বলেন যে, খোলা ছাড়াইয়া জীবিত ঝিনুক অথবা অয়স্টারকে যখন গলাধঃকরণ করা হয় তখন ঝিনুক কোনো কষ্টই অনুভব করে না, বরঞ্চ পাক-গহ্বরের উষ্ণতা অনুভব করিয়া উল্লসিত হয়। ব্যাঘ্রের উদরস্থ হইয়া কেহ ফিরিয়া আসে নাই, সুতরাং পাকস্থলীর অন্তর্গত হইবার সুখ চিরকাল অনির্বচনীয়ই থাকিবে।
জগদীশচন্দ্র বসু
জীবনের মাপকাঠি জগদীশচন্দ্র বসু এখন দেখা যাইক, জীবন্ত অবস্থার কোনোরূপ মাপকাঠি আছে কি না। জীবিত ও মৃতের কি প্রভেদ? যে জীবিত তাহাকে নাড়া দিলে সাড়া দেয়। কেবল তাহাই নহে; যে অধিক জীবন্ত সে একই নাড়ায় অতি বৃহৎ সাড়া দেয়। যে মৃতপ্রায় সে নাড়ার উত্তরে ক্ষুদ্র সাড়া দেয়। যে মরিয়াছে সে একেবারেই সাড়া দেয় না। সুতরাং আঘাত দিয়া জীবন্ত ভাবের পরিমাণ করিতে পারি। যে তেজস্বী সে অল্প আঘাতেই পূর্ণ সাড়া দিবে। আর যে দুর্বল সে অনেক তাড়না পাইয়াও নিরুত্তর থাকিবে। মনে করুন, কোনোপ্রকারে আমার অঙ্গুলির উপর বার বার আঘাত পড়িতেছে। আঘাত পাইয়া অঙ্গুলি আকুঞ্চিত হইতেছে এবং তজ্জন্য নড়িতেছে। অল্প আঘাতে অল্প নড়ে এবং প্রচণ্ড আঘাতে বেশি নড়ে। শুধু চক্ষে তাহার পরিমাণ প্রকৃতরূপে লক্ষিত হয় না। আকুঞ্চনের মাত্রা ধরিবার জন্য কোনোপ্রকার লিখিবার বন্দোবস্ত করা আবশ্যক। সম্মুখে যে পরীক্ষা দেখানো হইয়াছে তাহা হইতে কলের আভাস পাওয়া যাইবে। স্বল্প আঘাতের পরে স্বল্প আকুঞ্চন; কলমটা উপরের দিকে অল্প দূর উঠিয়া যায়, আকুঞ্চনরেখাও স্বল্প-আয়তনের হয়। বৃহৎ আঘাতে রেখাটা বড়ো হয়। কেবল তাহাই নহে। আঘাতের চকিত অবস্থা হইতে আমার পুনরায় প্রকৃতিস্থ হই; সংকুচিত অঙ্গুলি পুনরায় স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হয়। আঘাত দিলে সংকুচিত অঙ্গুলির টানে লিখিত রেখা হঠাৎ উপর দিকে চলিয়া যায়। প্রকৃতিস্থ হইতে কিছু সময় লাগে; ঊর্ধ্বোত্থিত রেখা ক্রমশঃ নামিয়া পূর্ব স্থানে আসে। আঘাতের বেদনা অল্প সময়েই পূর্ণ মাত্রা হইয়া থাকে; কিন্তু সেই বেদনা অন্তর্হিত হইতে সময় লাগে। সেইরূপ আকুঞ্চনের সাড়া অল্প সময়েই হইয়া থাকে; তাহা হইতে প্রকৃতিস্থ হইবার প্রসারণ-রেখা অধিক সময় লয়। গুরুতর আঘাতে বৃহত্তর সাড়া পাওয়া যায়; প্রকৃতিস্থ হইতে দীর্ঘতর সময় লাগে। বেদনাও অনেক কাল স্থায়ী হয়। যদি জীবিত পেশী একই অবস্থায় থাকে এবং একইবিধ আঘাত তাহার উপর বার বার পতিত হয়, তাহা হইলে সাড়াগুলি একই রকম হয়। কিন্তু জীবিত পেশী সর্বসময়ে একই অবস্থায় থাকে না; কারণ বাহ্য জগৎ এবং বিগত ইতিহাস আমাদিগকে মুহূর্তে মুহূর্তে নূতন রূপে গড়িতেছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রকৃতি মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হইতেছে। কখনও বা উৎফুল্ল, কখনও বা বিমর্ষ, কখনও বা মুমূর্ষ। এই সকল ভিতরের পরিবর্তন অনেক সময় বাহির হইতে বুঝা যায় না। যিনি দেখিতে ভালোমানুষটি তিনি হয়তো কোপনস্বভাব, অল্পেতেই সপ্তমে চড়িয়া বসেন; অন্যকে হয়তো কিছুতেই চেতানো যায় না। ব্যক্তিগত পার্থক্য, অবস্থাগত পরিবর্তন, তদ্ভিন্ন জীবনের অনেক ইতিহাস ও স্মৃতি আছে যাহার ছাপ অদৃশ্যরূপেই থাকিয়া যায়। সে সকল লুপ্ত কাহিনী কি কোনোদিন ব্যক্ত হইবে? প্রথমে মনে হয়, এই চেষ্টা একেবারেই অসম্ভব। দেখা যাউক, অসম্ভবও সম্ভব হইতে পারে কি না। কি করিয়া লোকের স্বভাব পরখ করিব? সাচ্চা ও ঝুটার প্রভেদ কি? টাকা পরখ করিতে হইলে বাজাইয়া লইতে হয়; আঘাতের সাড়া শব্দরূপে শুনিতে পাই। সাচ্চা ও ঝুটার সাড়া একেবারেই বিভিন্ন; একটাতে সুর আছে, অন্যটা একেবারে বেসুর। মানুষের প্রকৃতিও বাজাইয়া পরখ করা যায়। অদৃষ্ট দারুণ আঘাত দিয়া মানুষকে পরীক্ষা করে; সাচ্চ ও ঝুটার পরীক্ষা কেবল তখনই হয়। হয়তো এইরূপে জীবের প্রকৃতি ও তাহার ইতিহাস বাহির করা যাইতে পারে- আঘাত করিয়া এবং তাহার সাড়া লিপিবদ্ধ করিয়া। সাড়া-লিপি তো রেখা মাত্র; কোনোটা একটু বড়ো কোনোটা কিছু ছোটো। দুইটি রেখার সামান্য বিভেদ হইতে এমন অব্যক্ত, এমন অন্তরঙ্গ, এমন রহস্যময় ইতিহাস কিরূপে ব্যক্ত হইবে? কথাটা যত অসম্ভব মনে হয়, বাস্তবিক তত নয়। গ্রহবৈগুণ্যে হয়তো আমাদিগকে কোনোদিন আসামীরূপে আদালতে উপস্থিত হইতে হইবে। সেখানে আসামীর বাগাড়ম্বর করিবার অধিকার নাই। কৌসুলির জেরাতে কেবল ‘হাঁ’ কি ‘না, এইমাত্র উত্তর দিতে হইবে; অর্থাৎ কেবলমাত্র দুই প্রকার সাড়া দিতে পারিব-শিরের ঊর্ধ্বাধঃ অথবা দক্ষিণ-বামে আন্দোলন দ্বারা। যদি আসামীর নাকের উপর কালি মাখাইয়া সম্মুখে একখানি অতি শুভ্র স্ট্যাম্প-কাগজ ধরা যায় তাহা হইলে কাগজে দুই রকম সাড়া লিখিত হইবে। ইহার প্রকৃত নাকে-খৎ এবং এই দুইটি রেখাময়ী সাড়া দ্বারা স্বয়ং ধর্মাবতার বিচারপতি আমাদের সমস্ত জীবন পরীক্ষা করিবেন। সেই বিচারের ফলেই আমাদের ভবিষ্যৎ বাসস্থান নিরূপিত হইবে-কলিকাতায় কিংবা আন্দামানে, ইহলোকে কিংবা পরলোকে। এতক্ষণ মানুষের কথা বলিলাম। গাছের কথা ও তাহার গূঢ় ইতিহাসের কথা এখন। গাছের পরীক্ষা করিতে হইলে গাছকে কোনো বিশেষরূপে আঘাত দ্বারা উত্তেজিত করিতে হইবে এবং তাহার উত্তরে সে যে সংকেত করিবে তাহা তাহাকে দিয়াই লিপিবদ্ধ করাইতে হইবে। সেই লিখনভঙ্গী দিয়াই তাহার বর্তমান ও অতীত-ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইবে। সুতরাং এই দুরূহ প্রযত্ন সফল করিতে হইলে দেখিতে হইবে- ১. গাছ কি কি আঘাতে উত্তেজিত হয় এবং কিরূপে সেই আঘাতের মাত্রা নিরূপিত হইতে পারে? ২. আঘাত পাইয়া গাছ উত্তরে কিরূপ সংকেত করে? ৩. কি প্রকারে সেই সংকেত লিপিরূপে অঙ্কিত হইতে পারে? ৪. সেই লেখার ভঙ্গী হইতে কি করিয়া গাছের ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে? ৫. গাছের হাত, অর্থাৎ ডাল কাটিলে গাছ কি ভাবে তাহা অনুভব করে?
জীবনানন্দ দাশ
নীলিমা জীবনানন্দ দাশ রৌদ্র-ঝিলমিল উষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল, অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে-বারে নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে। উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী, উগ্র চুল্লীবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি’, আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা, মরীচিকা-ঢাকা। অগণন যাত্রিকের প্রাণ খুঁজে মরে অনিবার, পায়নাকো পথের সন্ধান; চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল; হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী! জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী; স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা! চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধিরলিপিকা, জ্ব’লে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা! বসুধার অশ্রুপাংশু আতপ্ত সৈকত, ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ, লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার, এই ধূলি—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার ডুবে যায় নীলিমায়—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে, শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে; ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
জীবনানন্দ দাশ
পিরামিড জীবনানন্দ দাশ বেলা ব’য়ে যায়, গোধূলির মেঘ-সীমানায় ধূম্রমৌন সাঁঝে নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে, শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে; পান্থ ম্লান চিতার কবলে একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ; কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ— কি এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন! অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন চকিতে মিলায়ে গেছে পাও নাই টের; কোন্ দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের দেউটি নিভায়ে গেছে—চ’লে গেছে দেউল ত্যজিয়া, চ’লে গেছে প্রিয়তম—চ’লে গেছে প্রিয়া যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী কবে কোন বেলাশেষে হায় দূর অস্তশেখরের গায়। তোমারে যায়নি তা’রা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া; সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী, তোরণে আসেনি তব লক্ষ-লক্ষ মরণ-সন্ধানী অশ্রু-ছলছল চোখে পাণ্ডুর বদনে; কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তা’রা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে জানো নাই তুমি; জানে না তো মিশরের মুক মরুভূমি তাদের সন্ধান। হে নির্বাক পিরামিড,—অতীতের স্তব্ধ প্রেতপ্রাণ, অবিচল স্মৃতির মন্দির, আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি ব’সে আছে স্থির; নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে মেঘরক্ত ময়ূখের পানে, জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে নূতন ভাস্কর; বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর নবোদিত অরুণের সনে— কোন্ আশা-দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে! পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু-দণ্ডের রুধিরফোয়ারা— কী এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া! থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন; শতাব্দীর বিরহীর মন নিটল নিথর সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত পীত সাগরের ’পর; বালুকার স্ফীত পারাবারে লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি’ মৌন ভিক্ষা মাগি। খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার মুখরিত প্রাণের সঞ্চার ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায়— বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই ব’সে আছে পিরামিড হায়। কতো আগন্তুক কাল অতিথি সভ্যতা তোমার দুয়ারে এসে ক’য়ে যায় অসম্বৃত অন্তরের কথা, তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল, তুমি রহো নিরুত্তর—নির্বেদী—নিশ্চল মৌন—অন্যমনা; প্রিয়ার বক্ষের ’পরে বসি’ একা নীরবে করিছো তুমি শবের সাধনা— হে প্রেমিক—স্বতন্ত্র স্বরাট। কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট উঠিবে জাগিয়া, সস্মিত নয়ন তুলি’ কবে তব প্রিয়া আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ পাণ্ডু চূর্ণ ব্যথিত কপোলে, মিশরঅলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্ব’লে, ব’সে আছে অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই; ওলটি-পালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি–প্রেমের প্রহরা। মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা হেমন্তের বিদায়-কুহেলি— অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান দু-দিনের তরে শুধু; নবোৎফুল্লা মাধবীর গান মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে নিমেষে চকিতে; অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে।
জীবনানন্দ দাশ
সেদিন এ-ধরণীর জীবনানন্দ দাশ সেদিন এ-ধরণীর সবুজ দ্বীপের ছায়া—উতরোল তরঙ্গের ভিড় মোর চোখে জেগে-জেগে ধীরে-ধীরে হ’লো অপহত কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো। দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল, সহসা উজানজলে ভাটা গেল ভাসি, অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার। সেইদিন মোর অভিসার মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে ভেসেছিলো আতুর উদাসী; বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি সেদিন শুনিনি তাহা; ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে অতিদূর তারকার কামনায় আঁখি মোর দিয়েছিনু খুলে। আমার এ শিরা-উপশিরা চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন, শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন— মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা—তোমার; ডেকেছিলো ভিজে ঘাস—হেমন্তের হিম মাস—জোনাকির ঝাড়, আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ—শ্মশানের খেয়াঘাট আসি, কঙ্কালের রাশি, দাউ-দাউ চিতা, কতো পূর্ব জাতকের পিতামহ পিতা, সর্বনাশ ব্যসন বাসনা, কতো মৃত গোক্ষুরার ফণা, কতো তিথি—কতো যে অতিথি— কতো শত যোনিচক্রস্মৃতি করেছিলো উতলা আমারে। আধো আলো—আধেক আঁধারে মোর সাথে মোর পিছে এলো তা’রা ছুটে, মাটির বাটের চুমো শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে, রোমপুটে; ধুধু মাঠ—ধানখেত—কাশফুল—বুনো হাঁস—বালুকার চর বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া; মাঝপথে থেমে গেল তা'রা সব; শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া দূরে—দূরে—আরো দূরে—আরো দূরে চলিলাম উড়ে, নিঃসহায় মানুষের শিশু একা—অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে অসীমের আঁচলের তলে স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে— দূর ছায়াপথে। পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি সহসা উঠিল ভাসি তারকাদর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি; ভ্রূণভ্রষ্ট সন্তানের তরে মাটি-মা ছুটিয়া এলো বুকফাটা মিনতির ভরে; সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু—বৃদ্ধ মৃত পিতা, সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা, মোর পাশে দাঁড়ালো সে গর্ভিণীর ক্ষোভে; মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন—জননীর প্রাণ; জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা শালতমালের ছায়া, এনেছে সে নব-নব ঋতুরাগ—পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া; তার তরে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী, মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজে রসে উঠিয়াছে ভরি, উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি, মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী; মশলাদরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে— কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু অমানিশা দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা! নয়ন মুদিনু ধীরে—শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে, সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।
জীবনানন্দ দাশ
অবসরের গান জীবনানন্দ দাশ শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে; মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয়; বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময় চারিদিকে এখন সকাল— রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল; মাঠের ঘাসের ’পরে শৈশবের ঘ্রাণ— পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান। চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল; প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে, যেই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর, চারিদিকে ছায়া—রোদ—খুদ—কুঁড়ো—কার্তিকের ভিড়; চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হ’তেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার— শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে; আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস; মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়। গাছের ছায়ার তলে মদ ল’য়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিলো ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য—জয়—সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিলো তুলে নেবো তার শীতলতা; ডেকে নেবো আইবুড়ো পাড়াগাঁর মেয়েদের সব; মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে— শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব। হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয়; দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ–অবসাদ– আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত। তখন শস্যের গন্ধ ফুরাযে গিয়েছে খেতে—রোদ গেছে প’ড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধ’রে; তখন গিয়েছে থেমে ওই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়; হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালীর বিছানার ’পর; মদের ফোঁটার শেষ হ’য়ে গেছে এ-মাঠের মাটির ভিতর, তখন সবুজ ঘাস হ’য়ে গেছে শাদা সব, হ’যে গেছে আকাশ ধবল, চ'লে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদেব দল। ২ পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে এসেছে বাহির হ’য়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের ’পরে; সবুজ ধানের নিচে—মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চ’লে গেছে; আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা; শস্যের খেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা। ফলন্ত মাঠের ’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন; ফসল—ধানের ফলে যাহাদের মন ভ'রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা ক’রে গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন— আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়— যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটিব নিচে পৃথিবীর তলে; কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায়নি তাদের সময়, পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তা’রা করে নাই ভয়, প্রণয়ীর মতো তা’রা ছেঁড়েনি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেযেদের নামে; চাষীদের মতো তা’রা ক্লান্ত হ’যে কপালের ঘামে কাটায়নি—কাটায়নি কাল; অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে, যোদ্ধা—জয়ী—বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে—পাশাপাশি— জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি! অনেক রাতের আগে এসে তা’রা চ'লে গেছে—তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়— আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা—জানে তাহা নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে-সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধ’রে যায় ডেকে-ডেকে। মাটির নিচের থেকে তা’রা মৃতের মাথার স্বপ্নে ন'ড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভূত ইশারা! আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে— আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে। সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর—বন্দর—বস্তি—কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই খেতে; শরীরের অবসাদ–হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে। শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধ’রে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে আমাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন জমি উপ্‌ড়ায়ে ফেলে চ’লে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার প’ড়ে আছে—পুরানো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে— দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে যায় চাঁদ; অবসর আছে তার—অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চ’লে যাবে পশ্চিমের পানে, এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে। ৩ ফুরোনো খেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নেই, কোনো কৃষকের মতো দরকার নেই দূরে মাঠে গিয়ে আর; রোধ—অবরোধ—ক্লেশ—কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়, জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে— কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়; আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং; দামামা থামায়ে ফেল—পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক্ রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ। এখানে নাহিকো কাজ—উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকে ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়। সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন— জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে। এখানে চকিত হ’তে হবেনাকো, ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই—এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়; এইখানে কাজ এসে জমেনাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে; এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর, রাখিবে না চোখ আর নয়নের ’পর; ভালোবাসা আসিবে না— জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর। অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে
জীবনানন্দ দাশ
ক্যাম্পে জীবনানন্দ দাশ এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি; সারারাত দখিনা বাতাসে আকাশের চাঁদের আলোয় এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি— কাহারে সে ডাকে! কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার; বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিযাছে, আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন, এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ঘুম আর আসেনাকো বসন্তের রাতে। চারিপাশে বনের বিস্ময়, চৈত্রের বাতাস, জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন; ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে; কোথাও অনেক বনে—যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার; তাহারা পেতেছে টের, আসিতেছে তার দিকে। আজ এই বিস্ময়ের রাতে তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে; তাহাদের হৃদয়ের বোন বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়— পিপাসার সান্ত্বনায়—আঘ্রাণে—আস্বাদে; কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন; মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই, সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু; কেবল পিপাসা আছে, রোমহর্ষ আছে। মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়; লালসা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হ’য়ে উঠিতেছে সব দিকে আজ এই বসন্তের রাতে; এইখানে আমার নকটার্ন। একে-একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে, সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে দাঁতের—নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই সুন্দরী গাছের নিচে—জ্যোৎস্নায়, মানুষ যেমন ক’রে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে হরিণেরা আসিতেছে। —তাদের পেতেছি আমি টের অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায, ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়। ঘুমাতে পারি না আর; শুয়ে-শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি; তারপর বন্দুকের শব্দ শুনি। চাঁদের আলোষ ঘাইহরিণী আবার ডাকে, এইখানে প’ড়ে থেকে একা-একা আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জ’মে ওঠে বন্দুকের শব্দ শুনে-শুনে হরিণীর ডাক শুনে-শুনে। কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া; সকালে—আলোয় তাকে দেখা যাবে— পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে। মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তাকে এই সব। আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো, …মাংস-খাওয়া হ’লো তবু শেষ? …কেন শেষ হবে? কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে তাদের মতন নই আমিও কি? কোনো এক বসন্তের রাতে জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে আমাকেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায়—দখিনা বাতাসে ওই ঘাইহরিণীর মতো? আমার হৃদয়—এক পুরুষহরিণ— পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে চিতার চোখের ভয়—চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে তোমাকে কি চায় নাই ধরা দিতে? আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো যখন ধূলায রক্তে মিশে গেছে এই হবিণীব মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি জীবনের বিস্ময়ের রাতে কোনো এক বসন্তের রাতে? তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে। মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস ল’য়ে আমরাও প’ড়ে থাকি; বিয়োগের—বিয়োগের—মরণের মুখে এসে পড়ে সব ঐ মৃত মৃগদের মতো। প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন ল’য়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা-মৃত্যু পাই; পাই না কি? দোনলার শব্দ শুনি। ঘাইমৃগী ডেকে যায়, আমার হৃদয়ে ঘুম আসেনাকো এক-একা শুয়ে থেকে; বন্দুকের শব্দ তবু চুপে-চুপে ভুলে যেতে হয়। ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে; যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা ম’রে যায় হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে তাহারাও তোমার মতন; ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয় কথা ভেবে—কথা ভেবে-ভেবে। এই ব্যথা—এই প্রেম সব দিকে র’য়ে গেছে— কোথাও ফড়িঙে-কীটে—মানুষের বুকের ভিতরে, আমাদের সবের জীবনে। বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই।
জীবনানন্দ দাশ
নির্জন স্বাক্ষর জীবনানন্দ দাশ তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে; যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’— পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার! তোমার এ জীবনের ধার ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল, তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই; শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে; আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে, —আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে। রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে— আকাশ ছডায়ে আছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে; জীবনের রং তবু ফলানো কি হয় এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময় পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল, চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল; রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে কোনো এক মানুষের তরে যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে। একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা; যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব'লে নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে। নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়— পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয় নতুনেরা আসিতেছে ব’লে; আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে কোনো এক মানুষীর তরে যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে। আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত। যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে আমার শরীরে— যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে তুমি আছো জেগে— যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে জেগে আছো; জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়। হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়; কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত— তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার। যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি; তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু— বাহিরের আকাশের শীতে নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে ঝ’রে— ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে। জানোনাকো তুমি তার স্বাদ— তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ, জীবন অগাধ। হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন তোমার। তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল? আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে। আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে; আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।
জীবনানন্দ দাশ
পাখিরা জীবনানন্দ দাশ ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে— বসন্তের রাতে বিছানায় শুয়ে আছি; —এখন সে কতো রাত! ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর। তারপর চ’লে যায় কোথায় আকাশে? তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে। শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে, চোখ আর চায় না ঘুমাতে; জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে, সাগরের জলের বাতাসে আমার হৃদয় সুস্থ হয়; সবাই ঘুমায়ে আছে সব দিকে— সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়? সাগরের ওই পারে—আরো দূর পারে কোনো এক মেরুর পাহাড়ে এই সব পাখি ছিলো; ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে দলে-দলে সমুদ্রের ’পর নেমেছিলো তারা তারপর, মানুষ যেমন তার মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে পড়ে। বাদামী—সোনালি—শাদা—ফুট্‌ফুট্‌ ডানার ভিতরে রবারের বলের মতন ছোটো বুকে তাদের জীবন ছিলো— যেমন রয়েছে মৃত্যু লক্ষ-লক্ষ মাইল ধ’রে সমুদ্রের মুখে তেমন অতল সত্য হ’য়ে। কোথাও জীবন আছে—জীবনের স্বাদ রহিয়াছে, কোথাও নদীর জল র’য়ে গেছে–সাগরের তিতা ফেনা নয়, খেলার বলের মতো তাদের হৃদয় এই জানিয়াছে; কোথাও রয়েছে প’ড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে তা’রা আসিয়াছে। তারপর চ’লে যায় কোন এক খেতে; তাহার প্রিয়ের সাথে আকাশের পথে যেতে-যেতে সে কি কথা কয়? তাদের প্রথম ডিম জন্মিবার এসেছে সময়। অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ-মাটির ঘ্রাণ, ভালোবাসা আর ভালোবাসার সন্তান, আর সেই নীড়, এই স্বাদ—গভীর—গভীর। আজ এই বসন্তের রাতে ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে; ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর, স্কাইলাইট মাথার উপর, আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর
জীবনানন্দ দাশ
বোধ জীবনানন্দ দাশ আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে; স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়; আমি তারে পারি না এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়। সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে। কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার। সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে, শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, শরীরে জলের গন্ধ মেখে, উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে চাষার মতন প্রাণ পেয়ে কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে? স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে। পথে চ’লে পারে—পারাপারে উপেক্ষা করিতে চাই তারে; মড়ার খুলির মতো ধ’রে আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে তবু সে মাথার চারিপাশে, তবু সে চোখের চারিপাশে, তবু সে বুকের চারিপাশে; আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে। আমি থামি— সেও থেমে যায়; সকল লোকের মাঝে ব’সে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা? জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে সন্তানের মতো হ’য়ে— সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়, কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয় যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে; তাদের হৃদয় আর মাথার মতন আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন আমার মনের মতো না কি? —তবু কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী। হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল? বাল্‌টিতে টানিনি কি জল? কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে? মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে ঘুরিয়াছি; পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে গিয়েছে জড়ায়ে; –এই সব স্বাদ; —এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ বয়েছে জীবন, নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন এক দিন; এই সব সাধ জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ; চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে; ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে; আমারে সে ভালোবাসিয়াছে, আসিয়াছে কাছে, উপেক্ষা সে করেছে আমারে, ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে ভালোবেসে তারে; তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা; আমি তার উপেক্ষার ভাষা আমি তার ঘৃণার আক্রোশ অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা আমি তা’ ভুলিয়া গেছি; তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা। মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে। আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে: সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়! অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়? কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন! মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন! শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন! এই বোধ—শুধু এই স্বাদ পায় সে কি অগাধ—অগাধ! পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ চায় না সে? করেছে শপথ দেখিবে সে মানুষের মুখ? দেখিবে সে মানুষীর মুখ? দেখিবে সে শিশুদের মুখ? চোখে কালো শিরার অসুখ, কানে যেই বধিরতা আছে, যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে, যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে —সেই সব।
জীবনানন্দ দাশ
মাঠের গল্প জীবনানন্দ দাশ মেঠো চাঁদ মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি—খড়—নাডা—মাঠের ফাটল, শিশিরের জল। মেঠো চাঁদ—কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা— চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত—নাই লেখা-জোখা। মেঠো চাঁদ বলে: ‘আকাশের তলে খেতে-খেতে লাঙলের ধার মুছে গেছে—ফসল-কাটার সময় আসিয়া গেছে—চ’লে গেছে কবে! শস্য ফলিয়া গেছে—তুমি কেন তবে রয়েছো দাঁড়ায়ে এক-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে খড়-নাড়া—পোড়ো জমি—মাঠের ফাটল, শিশিরের জল!’ ..... আমি তারে বলি: ‘ফসল গিয়েছে ঢের ফলি, শস্য গিয়েছে ঝ’রে কতো— বুড়ো হ’য়ে গেছ তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো! খেতে-খেতে লাঙলের ধার মুছে গেছে কতোবার—কতোবার ফসল-কাটার সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে! শস্য ফলিযা গেছে—তুমি কেন তবে রয়েছো দাঁড়ায়ে একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি—খড়-নাড়া—মাঠের ফাটল, শিশিরের জল!’ পেঁচা প্রথম ফসল গেছে ঘরে— হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল; অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে হিম হ’য়ে আসে বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা; বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা; ধানখেতে—মাঠে জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা; ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী— তবু পাই টের কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের কোনো সাধ। হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে, শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে, পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে, ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জাগে এক অঘ্রাণের রাতে সেই পাখি; আজ মনে পড়ে সেদিনও এমনি গেছে ঘরে প্রথম ফসল; মাঠে-মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর, কার্তিক কি অঘ্রাণের রাত্রির দুপুর; হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে, শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে, পাথার ছায়ায় শাখা ঢেকে, ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে, মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জেগেছিলো অঘ্রাণের রাতে এই পাখি। নদীটির শ্বাসে সে-রাতেও হিম হ’য়ে আসে বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা, বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা; ধানখেতে মাঠে জমিছে ধোঁয়াটে ধারালো কুয়াশা, ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী, তবু আমি পেয়েছি যে টের কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের কোনো সাধ। পঁচিশ বছর পরে শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে— বলিলাম—‘একদিন এমন সময় আবার আসিও তুমি—আসিবার ইচ্ছা যদি হয়— পঁচিশ বছর পরে।’ এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে; তারপর, কতোবার চাঁদ আর তারা মাঠে-মাঠে ম’রে গেল, ইঁদুর-পেঁচারা জ্যোৎস্নায় ধানখেত খুঁজে এলো গেল; চোখ বুজে কতোবার ডানে আর বাঁয়ে পড়িল ঘুমায়ে কতো-কেউ; রহিলাম জেগে আমি একা; নক্ষত্র যে-বেগে ছুটিছে আকাশে তার চেয়ে আগে চ’লে আসে যদিও সময়, পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়! তারপর—একদিন আবার হলদে তৃণ ভ’রে আছে মাঠে, পাতায়, শুকনো ডাঁটে ভাসিছে কুয়াশা দিকে-দিকে, চড়ুয়ের ভাঙা বাসা শিশিরে গিয়েছে ভিজে—পথের উপর পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা—কড়্‌কড়্‌; শসাফুল—দু-একটা নষ্ট শাদা শসা, মাকড়ের ছেঁড়া জাল—শুক্‌নো মাকড়সা লতায়—পাতায়; ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়; দেখা যায় কয়েকটা তারা হিম আকাশের গায়—ইঁদুর-পেঁচারা ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে, পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে! কার্তিক মাঠের চাঁদ জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ— পাহাড়ের মতো ওই মেঘ সঙ্গে ল’য়ে আসে মাঝরাতে কিংবা শেষরাতের আকাশে যখন তোমারে, —মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিলো যারে; ছেঁড়া-ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে তরাসে ছেলের মতো—আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে অনেক সময়— তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে—চাঁদ; পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়, একদিন হয়েছে যা—তারপর হাতছাড়া হ’য়ে হারায়ে ফুরায়ে গেছে—আজো তুমি তার স্বাদ ল’য়ে আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছো এসে! নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে, শস্যের খেত চ’ষে-চ’ষে গেছে চাষা চ’লে; তাদের মাটির গল্প—তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে অনেক তবুও থাকে বাকি— তুমি জানো—এ-পৃথিবী আজ জানে তা কি!
জীবনানন্দ দাশ
মৃত্যুর আগে জীবনানন্দ দাশ আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে; আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো, খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার: পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো! বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক; আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক; আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে, আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে; শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস; দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ, হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা, ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ, চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে; মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে, বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে, নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে, খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে; বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে; নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে; আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে; যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল; পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে; আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ, প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ; আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা; চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির: পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর; আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে। কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
জীবনানন্দ দাশ
শকুন জীবনানন্দ দাশ মাঠ থেকে মাঠে-মাঠে—সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে-আকাশে শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি; নিস্তব্ধ প্রান্তর শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে আরেক আকাশ যেন—সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর কঠিন মেঘের থেকে; যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিক্‌হস্তিগণ প’ড়ে গেছে—প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার খেত মাঠ প্রান্তরের পর এই সব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহূর্ত শুধু; আবার করিছে আরোহণ আঁধার বিশাল ডানা পাম গাছে—পাহাড়ের শিঙে-শিঙে সমুদ্রের পারে; একবার পৃথিবীর শোভা দেখে, বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দ্যাখে তাই; একবার স্নিগ্ধ মালাবারে উড়ে যায়—কোন্ এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন্ মৃত্যুর ওপারে; যেন কোন্ বৈতরণী অথবা এ-জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন কেঁদে ওঠে...চেয়ে দ্যাখে কখন গভীর নীলে মিশে গেছে সেই সব হূন।
জীবনানন্দ দাশ
সহজ জীবনানন্দ দাশ আমার এ-গান কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে— আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে, তবুও হৃদয়ে গান আসে। ডাকিবার ভাষা তবুও ভুলি না আমি— তবু ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে; পৃথিবীর কানে নক্ষত্রের কানে তবু গাই গান; কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি— আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে— তবুও হৃদয়ে গান আসে। তুমি জল, তুমি ঢেউ–সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার দেহের বেগ—তোমার সহজ মন ভেসে যায় সাগরের জলের আবেগে; কোন্ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিলো লেগে কোন্ অন্ধকারে জানে না সে; কোন্ ঢেউ তারে অন্ধকারে খুঁজিছে কেবল জানে না সে; রাত্রির সিন্ধুর জল রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ তুমি এক; তোমারে কে ভালোবাসে; তোমারে কি কেউ বুকে ক’রে রাখে। জলের আবেগে তুমি চ’লে যাও— জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধুধু জল তোমারে যে ডাকে। তুমি শুধু একদিন, এক রজনীর; মানুষের—মানুষীর ভিড় তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে—কতো দূরে— কোন্ সমুদ্রের পারে, বনে—মাঠে—কিংবা যে-আকাশ জুড়ে উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে— কিংবা যে-আকাশে কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ জেগে ওঠে—ডুবে যায়—তোমার প্রাণের সাধ তাহাদের তরে; যেখানে গাছের শাখা নড়ে শীত রাতে—মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন— যেইখানে বন আদিম রাত্রির ঘ্রাণ বুকে ল’য়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান— তুমি সেইখানে। নিঃসঙ্গ বুকের গানে নিশীথের বাতাসের মতো একদিন এসেছিলে, দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত।
জীবনানন্দ দাশ
স্বপ্নের হাতে জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীর বাধা— এই দেহের ব্যাঘাতে হৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতে আমি তাই আমারে তুলিয়া দিতে চাই। যেই সব ছায়া এসে পড়ে দিনের রাতের ঢেউয়ে— তাহাদের তরে জেগে আছে আমার জীবন; সব ছেড়ে আমাদের মন ধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতে পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে বেদনা পেত না তবে কেউ আর— থাকিত না হৃদয়ের জরা— সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা। আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে, সারা দিন— সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে, পৃথিবীর যত ব্যথা— বিরোধ— বাস্তব হৃদয় ভুলিয়া যায় সব; চাহিয়াছে অন্তর যে-ভাষা, যেই ইচ্ছা— যেই ভালোবাসা খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে-পারে গিয়া— স্বপ্নে তাহা সত্য হ’য়ে উঠেছে ফলিয়া। মরমের যত তৃষ্ণা আছে— তারি খোঁজে ছায়া আর স্বপনের কাছে তোমরা চলিয়া এসো— তোমরা চলিয়া এসো সব! ভুলে যাও পৃথিবীর ওই ব্যথা— ব্যাঘাত— বাস্তব! সকল সময় স্বপ্ন— শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় যাদের অন্তরে, পরস্পরে যারা হাত ধরে নিরালা ঢেউয়ের পাশে-পাশে— গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে যাহাদের আকাঙ্ক্ষার জন্ম— মৃত্যু— সব— পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব শোনে না তাহারা; সন্ধ্যার নদীর জল— পাথরে জলের ধারা আয়নার মতো জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত তাহাদের তরে। তাদের অন্তরে স্বপ্ন, শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় সকল সময় … পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা— সে-সব ব্যর্থতা আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া; দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়— ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি, তবে ওই পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে লিখিতে ষেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে অন্তরের কথা; আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে-সব ব্যর্থতা। পৃথিবীর ওই অধীরতা থেমে যায়— আমাদের হৃদয়ের ব্যথা দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে স্বপ্নেরে— ধ্যানেরে কাছে ডেকে লয়; উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়, মানুষেরো আয়ু শেষ হয়। পৃথিবীর পুরানো সে-পথ মুছে ফেলে রেখা তার— কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয়! সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব— নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়!
জীবনানন্দ দাশ
অন্ধকার জীবনানন্দ দাশ গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার; তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম— পউষের রাতে— কোনোদিন আর জাগবো না জেনে কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর— হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও, হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে রয়েছে যে অগাধ ঘুম সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই, তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও— জানো না কি চাঁদ, নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, জানো না কি নিশীথ, আমি অনেক দিন— অনেক অনেক দিন অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে বুঝতে পেরেছি আবার; ভয় পেয়েছি, পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা; দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছে; আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়— বেদনায়— আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে; সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে। হায়, উৎসব! হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন; আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই। যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ, সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি, শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে, শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর; এই সব ভয়াবহ আরতি! গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন। অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর; তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে— কোনোদিন জাগবো না জেনে— কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।
জীবনানন্দ দাশ
আবহমান জীবনানন্দ দাশ পৃথিবী এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম। সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে; যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে; যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় খেতের গোধূম চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম গাঢ় ক’রে দিয়ে যায়। —এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের। সমুদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ নদীর তরঙ্গে— ক্রমে— তুষারের স্তূপে তার ঢেউ একবার টের পাবে— দ্বিতীয় বারের সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে টের এইখানে সময়কে যতদূর দেখা যায় চোখে নির্জন খেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভূত চাষা; এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে; অঘ্রাণের বিকেলের কমলা আলোকে নিড়ানো খেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে; একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে। পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে নষ্ট হ’য়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে; সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে। ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হ’য়ে আসে। মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হ’লো মানুষের বৃত্তি আদায়। যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায় আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন। অভিভূত হ’য়ে আছে— চেয়ে দ্যাখো— বেদনার নিজের নিয়ম। নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়; জলপাই-অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা; ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়; প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে। সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়। পৃথিবীর রাজপথে— রক্তপথে— অন্ধকার অববাহিকায় এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়। তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মূক অপেক্ষায়; তাহার মাথার ’পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়; এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হ’য়ে থেকে ক্রমে একদিন কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ? চেয়েছে মাটির দিকে— ভূগর্ভে তেলের দিকে সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা, মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার; দূরবীনে কিমাকার সিংহের সাড়া পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে। বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তা’রা। যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে, মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে; চিরদিন এই সব হৃদয় ও রুধিরের ধারা। মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে; অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া। মোমের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে ব’সে— অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে আমরা যতটা দূর চ’লে যাই— চেয়ে দেখি আরো-কিছু আছে তারপরে। অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে ছায়া ফেলে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে, কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে, অথবা যে-সব থাম সমীচীন মিস্ত্রির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে, তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ। হয়তো অনেক এগিয়ে তা’রা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোল্‌তার নেই অবলেশ। তাই তা’রা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরো জীবনের লিপ্ত অভিধানে বৰ্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে। সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয়— এই জ্ঞানে লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে নিজের বীজের তরে জোর ক’রে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে। অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে। একটি আলোক নিয়ে ব’সে থাকা চিরদিন; নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে; সে-সবের দিন শেষ হ’য়ে গেছে এখন সৃষ্টির মনে— অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে। সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে। একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে— বালুচরে, সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে। আমরা জটিল ঢের হ’য়ে গেছি— বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে। যদি কেউ বলে এসে: ‘এই সেই নারী, একে তুমি চেয়েছিলে; এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ—’ তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কবে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ? আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর, যদিও অনেক মৃত্যুপরম্পরা ছিলো ইতিহাসে; বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অব্‌লঙ ছবি; নানারূপ ক্ষতি ক্ষয়ে নানা দিকে ম’রে গেছি— মনে পড়ে বটে এই সব ছবি দেখে; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থানু। এক দরজায় ঢুকে বহিষ্কৃত হ’য়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে অমেয় আলোয় হেঁটে তা’রা সব। (আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্ বাতাসের শব্দ শুনেছিলো; তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?) আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি কাচের গেলাসে জলে উজ্জ্বল শফরী; সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো; তারপর অন্য গ্রহ নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে। সৃষ্টির নাড়ীর ’পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায় অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ; তবু তা’রা করেনাকো পরস্পরের ঋণশোধ।
জীবনানন্দ দাশ
আমাকে তুমি জীবনানন্দ দাশ আমাকে তুমি দেখিয়েছিলে একদিন: মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল; দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়; জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার; জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে: পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়। তারপর দূরে অনেক দূরে খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায় এই দুপুরের বাতাস। এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন। বিকেলে নরম মুহূর্ত; নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া; একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো নদীর জলে সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে স্থির। মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ, আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ; বিকেলে অসম্ভব বিষণ্ণতা। ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু— বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা; শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়— ছায়ায়, রাত্রি; নক্ষত্র ও নক্ষত্রের অতীত নিস্তব্ধতা। মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।
জীবনানন্দ দাশ
তুমি জীবনানন্দ দাশ নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ; বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস; কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে— গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প’ড়ে আছো তুমি। ‘মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছো? কিংবা দূর আকাশের পারে তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছো আঁধারে? ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে: মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি— তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’ বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
জীবনানন্দ দাশ
তোমাকে জীবনানন্দ দাশ একদিন মনে হ’তো জলের মতন তুমি। সকালবেলার রোদে তোমর মুখের থেকে বিভা— অথবা দুপুরবেলা— বিকেলের আসন্ন আলোয়— চেয়ে আছে— চ’লে যায়— জলের প্রতিভা। মনে হ’তো তীরের উপরে ব’সে থেকে। আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল কেউ-কেউ তুলে নিয়ে চ’লে গেলে— নিচে তোমার মুখের মতন অবিকল নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে; স্থানান্তরিত হ’য়ে দিবসের আলোর ভিতরে নিজের মুথের ঠাণ্ডা জলরেখা নিয়ে পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে; এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হ’য়ে গেছে জেনে এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় ব’লে রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়; অপরাহ্ণে আকাশের রং ফিকে হ’লে। তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল; তোমার বুকের ’পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস; তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর রাত: নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।
জীবনানন্দ দাশ
ধান কাটা হ’য়ে গেছে জীবনানন্দ দাশ ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন— খেতে মাঠে প’ড়ে আছে খড় পাতা কুটো ভাঙা ডিম— সাপের খোলস নীড় শীত। এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়। ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন, হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ; শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।
জীবনানন্দ দাশ
পথ হাঁটা জীবনানন্দ দাশ কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথে অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে; তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে: সারা রাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো ক’রে জ্বলে। কেউ ভুল করেনাকো— ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব চুপ হ’য়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে। এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব; তখন অনেক রাত— তখন অনেক তারা মনুমেণ্ট মিনারের মাথা নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব আর-কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা-আর-মনুমেণ্ট-ভরা কলকাতা? চোখ নিচে নেমে যায়— চুরুট নীরবে জ্বলে— বাতাসে অনেক ধুলো খড়; চোখ বুজে একপাশে স’রে যাই— গাছ থেকে অনেক বাদামী জীর্ণ পাতা উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।
জীবনানন্দ দাশ
বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
জীবনানন্দ দাশ
ভিখিরী জীবনানন্দ দাশ একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো— তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে-মানে। —ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত। আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত; তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত। একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো— তা হ’লে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা। —ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ। ভিড়ের ভিতরে তবু— হ্যারিসন রোডে— আরো গভীর অসুখ, এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে: এক পৃথিবীর ভুলচুক।
জীবনানন্দ দাশ
সবিতা জীবনানন্দ দাশ সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে: ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি, তাহাদের সাথে সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন; মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী রেশম, মদের সার্থবাহ, দুধের মতন শাদা নারী। অনন্ত রৌদের থেকে তারা শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে সহসা বিকেলবেলা শেষ হ’য়ে গেলে চ’লে যেত কেমন নীরবে। চারিদিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র; মধ্যযুগের অবসান স্থির ক’রে দিতে গিয়ে ইওরোপ গ্রীস হতেছে উজ্জ্বল খ্রীষ্টান। তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা— সিন্ধুর রাত্রির জল জানে— আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে; কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে আমরা আকুল হ’য়ে উঠে মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধ করা হবে জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায় যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে। এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে; কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন! তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে কবেকার সমুদ্রের নুন; তোমার মুখের রেখা আজো মৃত কতো পৌত্তলিক খ্রীষ্টান সিন্ধুর অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন; কতো কাছে— তবু কতো দূর।
জীবনানন্দ দাশ
সুচেতনা জীবনানন্দ দাশ সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে; সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে। এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়। কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে; তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়। আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে; পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে। কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়; সেই শস্য অগণন মানুষের শব; শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ মূক ক’রে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান। সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে; সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ; এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল; প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে। মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি, না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে; এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে; দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়— শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
জীবনানন্দ দাশ
সুরঞ্জনা জীবনানন্দ দাশ সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো; পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন; কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো; গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? —গিয়েছে হারায়ে। বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো; তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা; একটি পাখির গান কী রকম ভালো। মানুষ কাউকে চায়— তার সেই নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল। মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়, আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়। যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে; তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
জীবনানন্দ দাশ
অনুপম ত্রিবেদী জীবনানন্দ দাশ এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে। যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তূপ দেখে মনে হয় যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ-নিজ চিন্তার বিষয় পরিশেষ ক’রে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে এখন ঘুমায়ে আছে— তাহদের ঘুম ভেঙে দিতে নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে— ওই পারে মৃত্যুর তালা ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা ঈশার শবোত্থান— বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে হেগেল ও মার্কস: তার ডান আর বাম কান ধ’রে দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিলো; এমন সময় দু-পকেটে হাত রেখে ভ্রূকুটিল চোখে নিরাময় জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম; প্রেমের চেয়েও ভালো মনে হ’লো একটি টোটেম: উটের ছবির মতো— একজন নারীর হৃদয়ে; মুখে-চোখে আকুতিতে মরীচিকা জয়ে চলেছে সে; জড়ায়েছে ঘিয়ের রঙের মতো শাড়ি; ভালো ক’রে দেখে নিলে মনে হয় অতীব চতুর দক্ষিণরাঢ়ী দিব্য মহিলা এক; কোথায় যে আঁচলের খুঁট; কেবলি উত্তরপাড়া ব্যাণ্ডেল কাশীপুর বেহালা খুরুট ঘুরে যায় স্টালিন, নেহেরু, ব্লক, অথবা রায়ের বোঝা ব’য়ে, ত্রিপাদ ভূমির পরে আরো ভূমি আছে এই বলির হৃদয়ে? তা হ’লে তা’ প্রেম নয়; ভেবে গেল ত্রিবেদীর হৃদয়ের জ্ঞান। জড় ও অজড় ডায়ালেকটিক মিলে আমাদের দু-দিকের কান টানে ব’লে বেঁচে থাকি— ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিলো টান।
জীবনানন্দ দাশ
আট বছর আগের একদিন জীবনানন্দ দাশ শোনা গেল লাসকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে; কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হ’লো তার সাধ; বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো; প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার। এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি! রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার; কোনোদিন জাগিবে না আর। ‘কোনোদিন জাগিবে না আর জানিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম— অবিরাম ভার সহিবে না আর—’ এই কথা বলেছিলো তারে চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে যেন তার জানালার ধারে উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে। তবুও তো পেঁচা জাগে; গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা; মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে। রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি; সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি। ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন; দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ মরণের সাথে লড়িয়াছে; চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা; যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা এই জেনে। অশ্বত্থের শাখা করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে করেনি কি মাখামাখি? থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে চমৎকার! ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’ জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার? জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের– তোমার অসহ্য বোধ হ’লো; মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো মর্গে— গুমোটে থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে। শোনো তবু এ মৃতের গল্প; কোনো নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই; বিবাহিত জীবনের সাধ কোথাও রাখেনি কোনো খাদ, সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ মধু— আর মননের মধু দিয়েছে জানিতে; হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই; তাই লাসকাটা ঘরে চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে। জানি— তবু জানি নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি; অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়— আরো-এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে ক্লান্ত— ক্লান্ত করে; লাসকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই; তাই লাসকাটা ঘরে চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে। তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা, থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে এসে চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে? চমৎকার! ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার—’ হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার? আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার; আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
জীবনানন্দ দাশ
কুড়ি বছর পরে জীবনানন্দ দাশ আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি! আবার বছর কুড়ি পরে— হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে— তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে। অথবা নাইকো ধান খেতে আর; ব্যস্ততা নাইকো আর, হাঁসের নীড়ের থেকে খড় পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার— তখন হঠাৎ যদি মেঠে পথে পাই আমি তোমারে আবার! হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার, শিরীষের অথবা জামের, ঝাউয়ের— আমের; কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে! জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার— তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে— বাবলার গলির অন্ধকারে অশথের জানালার ফাঁকে কোথায় লুকায় আপনাকে! চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে— সোনালি-সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে— কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!
জীবনানন্দ দাশ
ঘাস জীবনানন্দ দাশ কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা; কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস— তেম্নি সুঘ্রাণ— হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে-গেলাসে পান করি, এই ঘাসের শরীর ছানি– চোখে চোখ ঘষি, ঘাসের পাখনায় আমার পালক, ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।
জীবনানন্দ দাশ
নগ্ন নির্জন হাত জীবনানন্দ দাশ আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হ’য়ে উঠছে: আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার। যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, সেই নারীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হ’য়ে উঠছে। মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে। ভারতসমুদ্রের তীরে কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিলো একদিন, কোনো এক প্রাসাদ ছিলো; মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ: পারস্য গালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল, আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা, আর তুমি নারী— এই সব ছিলো সেই জগতে একদিন। অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো, অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো, মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক; অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো, অনেক কমলা রঙের রোদ; আর তুমি ছিলে; তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না। ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী, অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা, লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ, অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি, রামধনু রঙের কাচের জানালা, ময়ূরের পেখমের মতে রঙিন পর্দায়-পর্দায় কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের ক্ষণিক আভাস— আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়। পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ! তোমার নগ্ন নির্জন হাত; তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
জীবনানন্দ দাশ
বিড়াল জীবনানন্দ দাশ সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয় গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে; কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতে নিমগ্ন হ’য়ে আছে দেখি; কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে, সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে। একবার তাকে দেখা যায়, একবার হারিয়ে যায় কোথায়। হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রং-এর সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে; তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতে থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে, সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিলো।
জীবনানন্দ দাশ
বুনো হাঁস পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে— জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে বুনো হাঁস পাখা মেলে— সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার; এক— দুই— তিন— চার— অজস্র— অপার— রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে— ছুটিতেছে তা’রা। তারপর প’ড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ, হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ— দু-একটা কল্পনার হাঁস; মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ; উড়ুক উড়ুক তা’রা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।
জীবনানন্দ দাশ
মনোকণিকা জীবনানন্দ দাশ ও. কে. একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো; একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে; একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো; তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে। বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব। অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে অপরের নিয়মে নীরব। মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়; সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়; সব দিক ও. কে.। সাবলীল আকাশে সূর্যের আলো থাকুক না— তবু— দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে। আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই। মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে। মাঝে-মাঝে পুরুষার্থ উত্তেজিত হ’লে— (এ রকম উত্তেজিত হয়;) উপস্থাপয়িতার মতন আমাদের চায়ের সময় এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে। সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম; এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম। এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল: প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়— অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল। মানুষ সর্বদা যদি মানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো— (স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে), অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো, পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে, সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি যেমন সে প্রায়শই করে, পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা, অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে। চার্বাক প্রভৃতি— ‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়, মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়। তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’ ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল, চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর; অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা— অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর। সমুদ্রতীরে পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব। এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের আলোর পথে এসে জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে। এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে; তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।
জীবনানন্দ দাশ
শঙ্খমালা জীবনানন্দ দাশ কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়— সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে— ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে। দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা: সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা— বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর, শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর। কড়ির মতন শাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে-আগুনে হায়। চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার; স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার; এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।
জীবনানন্দ দাশ
শব জীবনানন্দ দাশ যেখানে রুপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর, যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর; যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায় সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়; নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ; কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল বিকেলের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী রাঙা মেঘ— হলুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি; অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো; লাল নীল মাছ মেঘ— ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল রুপালি নীরব।
জীবনানন্দ দাশ
শিকার জীবনানন্দ দাশ ভোর; আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল: চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ। একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে: পাড়াগাঁর বাসরঘরে সব চেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো; কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে-মুক্তা আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিলো হাজার-হাজার বছর আগে এক রাতে— তেম্নি— তেম্নি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনও। হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে— মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; শুকনো অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনও আগুন জ্বলছে তাদের; সূর্যের আলোয় তার রং কুঙ্কুমের মতো নেই আর; হ’য়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো। সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে। ভোর; সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে-ঘুরে সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে; কচি বাতাবী লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে; নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামলো— ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য; অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য; এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতে জেগে উঠে সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য। একটা অদ্ভুত শব্দ। নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল। আগুন জ্বললো আবার— উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হ’য়ে এলো। নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় ব’সে অনেক পুরানো শিশিরভেজা গল্প; সিগারেটের ধোঁয়া; টেরিকাটা কয়েকটা মহিষের মাথা; এলোমেলো কয়েকট বন্দুক— হিম– নিঃস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।
জীবনানন্দ দাশ
সিন্ধুসারস জীবনানন্দ দাশ দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি হে সিন্ধুসারস, মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি নাচিতেছ টারান্‌টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায় ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়। মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান, আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান। জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি? অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে— হারায়েছি আনন্দের গতি; ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান— এই বর্তমান হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের— বেদনার আমরা সন্তান? জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান, তুমি পিছে চাহোনাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর। যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত নেই তব; নেই নিম্নভূমি—নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত। স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো— পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতে রেখা প্রাণে তার— ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো; একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো নিভে গেছে; যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, করে না বুনন মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে অবিচল শালিকের মন, মেঘের দুপুর ভাসে— সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে; সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে; তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনোনাকো; অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে জানোনাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে; সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে; গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের— ইন্দ্রধনু পরিবার ক্লান্ত আয়োজন হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন। এই সব জানোনাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডানার উল্লাসে; রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডান শাদা ফেনা-শিশুদের পাশে হেলিওট্রোপের মতে দুপুরের অসীম আকাশে! ঝিকমিক করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা, যদিও এ পৃথিবীর স্বপ্ন চিন্তা সব তার অচেনা অজানা। চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি— জন্ম তুমি নিয়েছিলে কবে, বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে— দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে। শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে। ধানের রসের গল্প পৃথিবীর— পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই– আর তার প্রেমিকের ম্লান নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায় শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।
জীবনানন্দ দাশ
সুবিনয় মুস্তফী জীবনানন্দ দাশ সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে। এক সাথে বেরাল ও বেরালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিলো ভূয়োদর্শী যুবার। ইঁদুরকে খেতে-খেতে শাদা বেরালের ব্যবহার, অথবা টুকরো হ’তে-হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর: বৈকুণ্ঠ ও নরকের থেকে তা’রা দুই জনে কতোখানি দূর ভুলে গিয়ে আধে আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেত— মাটির দরের মতো রেটে; তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেত ব’লে বেরালের পেটে ইঁদুর ‘হুর্‌রে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে।
জীবনানন্দ দাশ
হাওয়ার রাত জীবনানন্দ দাশ গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল— অসংখ্য নক্ষত্রের রাত; সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, কখনো বিছানা ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে; এক-একবার মনে হচ্ছিলো আমার–আধো ঘুমের ভিতর হয়তো— মাথার উপরে মশারি নেই আমার, স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে! কাল এমন চমৎকার রাত ছিলো। সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো— আকাশে এক তিল ফাঁক ছিলো না; পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি; অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা; জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ! কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো। যে-নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম'রে গিয়েছে তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে ক’রে এনেছে; যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি— কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায়-কুয়াশায দীর্ঘ বর্শা হাতে ক’রে কাতারে-কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন— মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য? আড়ষ্ট—অভিভূত হয়ে গেছি আমি, কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন; আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল; আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে আমার জানালার ভিতর দিয়ে সাঁই সাঁই ক’রে, সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো। হৃদয় ভ’রে গিযেছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে, মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়। আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল, নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে, একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে নিযে চললো একটা দুরন্ত শকুনের মতো।
জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর শুধু খেলা করে জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো: চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ; বালির উপরে জ্যোৎস্না— খেজুর-ছায়ারা ইতস্তত বিচূর্ণ থামের মতো: এশিরিয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান। শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের— ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন; ‘মনে আছে?’ সুধালো সে— সুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন।’
জীবনানন্দ দাশ
হায় চিল জীবনানন্দ দাশ হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে! তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে; পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ’লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।
জীবনানন্দ দাশ
অশ্বত্থ বটের পথে জীবনানন্দ দাশ অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী; ছড়ায়েছি খই ধান বহুদিন উঠানের শালিখের তরে; সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে গিয়েছি অনেক দিন,—দেখিয়াছি ধূপ জ্বাল, ধর সন্ধ্যাবাতি থোড়ের মতন শাদা ভিজে হাতে,—এখুনি আসিবে কিনা রাতি বিনুনি বেঁধেছ তাই—কাঁচপোকাটিপ তুমি কপালের ’পরে পরিয়াছ...তারপর ঘুমায়েছ: কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে পানের বাটার ’পরে; নোনার মতন নম্র শরীরটি পাতি নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ,—বউকথাকওটির ছানা নীল জামরুল নীড়ে—জ্যোৎস্নায়—ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়, আর রাত্রি মাতা-পাখিটির মতো ছড়ায়ে রয়েছে তার ডানা।... আজ আমি ক্লান্ত চোখে ব্যবহৃত জীবনের ধূলোয় কাঁটায় চ’লে গেছি বহু দূরে;—দেখ নিকো, বোঝ নিকো, কর নিকো মানা; রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন—পানের বাটায়। ১৩২৬-এর কতকগুলো দিনের স্মরণে
জীবনানন্দ দাশ
অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া জীবনানন্দ দাশ অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবনে সঙ্কট শেষ হয়ে গেছে আজ;—চেয়ে দেখ কত শত শতাব্দীর বট হাজার সবুজ পাতা লাল ফল বুকে লয়ে শাখার ব্যজনে আকাঙ্ক্ষার গান গায়—অশ্বত্থেরো কি যেন কামনা জাগে মনে: সতীর শীতল শব বহু দিন কোলে লয়ে যেন অকপট উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে,—চন্দ্রশেখরের মতো তার জট উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদে আজ পুনরাগমনে; মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পারে গৌরী বাংলার এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি—রায়গুণাকর আসিবে না—দেশবন্ধু, আসিয়াছে খরধার পদ্মায় এবার, কালীদহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়, আসিয়াছে চণ্ডীদাস—রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার: শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা: মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর। দেশবন্ধু: ১৩২৬-১০৩২-এর স্মরণে
জীবনানন্দ দাশ
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে জীবনানন্দ দাশ আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে ব’সে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে—আসিয়াছে শান্ত অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা—কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে: আমার চোখের ’পরে আমার মুখের ’পরে চুল তার ভাসে; পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখে নিকো—দেখি নাই অত অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে র‍ূপসীর চুলের বিন্যাসে পৃথিবীর কোনো পথে:নরম ধানের গন্ধ—কল্‌মীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত—শীত হাতখান, কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাস,—লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা—এরি মাঝে বাংলার প্রাণ: আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফাুটে আমি পাই টের।
জীবনানন্দ দাশ
আজ তারা কই সব জীবনানন্দ দাশ আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক—পুকুরের জলে বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হ’ল কবে কখন সে ঝ’রে গেল, কখন ফুরাল, আহা,—চ’লে গেল কবে যে নীরবে, তাও আর জানি নাকো;—ঠোঁট-ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে রোজ ভোরে দেখা দিত—অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে তারে আর দেখি নাকো—কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে, জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল—হৃদয়ের গভীর উৎসবে খেলা ক’রে গেছে তারা কত দিন—ফড়িঙ্ কীটের দিন যত দিন চলে তাহারা নিকটে ছিল—রোদের আনন্দে মেতে—অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে বহুদিন কাছে ছিল;—অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ—মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে; কোথায় গিয়েছে তারা? অই দূর আকাশের নীল লাল তারার ভিতরে অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু—ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে? শুধালাম ... উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে।
জীবনানন্দ দাশ
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে জীবনানন্দ দাশ আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়,—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হ’ব—কিশোরীর—ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে; আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ কর‍ুণ ডাঙায়; হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শ‍ুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশ‍ু এক উঠানের ঘাসে; র‍ূপ্‌সার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়;—রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে—
জীবনানন্দ দাশ
আমাদের রূঢ় কথা জীবনানন্দ দাশ আমাদের রূঢ় কথা শুনে তুমি সরে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ; তোমার অনন্ত নীল সোনালি ভোমরা নিয়ে কোনো দূর শান্তির ভিতরে ডুবে যাবে?... কত কাল কেটে গেল, তবু তার কুয়াশার পর্দা না স’রে পিরামিড্ বেবিলন শেষ হ’ল—ঝ’রে গেল কতবার প্রান্তরের ঘাস; তবুও লুকায়ে আছে যেই রূপ নক্ষত্রে তা’ কোনোদিন হ’ল না প্রকাশ; যেই স্বপ্ন যেই সত্য নিয়ে আজ আমরা চলিয়া যাই ঘরে, কোনো এক অন্ধকারে হয়তো তা’ আকাশের যাযাবর মরালের স্বরে নতুন স্পন্দন পায়—নতুন আগ্রহে গন্ধে ভ’রে ওঠে পৃথিবীর শ্বাস; তখন আমরা অই নক্ষত্রের দিকে চাই—মনে হয় সব অস্পষ্টতা ধীরে ধীরে ঝরিতেছে,—যেই রূপ কোনোদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে, যেই শান্তি মৃত জননীর মতো চেয়ে থাকে—কয় নাকো কথা, যেই স্বপ্ন বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে, আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ—অন্ধ মৃত হিম, একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে র’বে গোলাপের মতন রক্তিম৷
জীবনানন্দ দাশ
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি জীবনানন্দ দাশ এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি ব’সে নিজ মনে একা; চালতার পাতা থেকে টুপ্ টুপু জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির; কুয়াশায় স্থির হয়ে ছিল ম্লান ধানসিড়ি নদীটির তীর; বাদুড় আঁধার ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা আকাঙ্ক্ষার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির .. কিশোরীর ভিড় আমের বউল দিল শীতরাতে;—আনিল আতার হিম ক্ষীর; মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম,—এ-কবিতা লেখা তাহাদের ম্লান চুল মনে ক’রে; তাহাদের কড়ির মতন ধূসর হাতের রূপ মনে ক’রে; তাহাদের হৃদয়ের তরে। সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন তাদের হলুদ শাড়ি—ক্ষীর দেহ—তাহাদের অপরূপ মন চ’লে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত্বনার ঘরে: আমার বিষণ্ণ স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে।
জীবনানন্দ দাশ
এই জল ভালো লাগে জীবনানন্দ দাশ এই জল ভালো লাগে;—বৃষ্টির রুপালি জল কত দিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ—বুলায়ে দিয়েছে চুল—চোখের উপরে তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,—আবেগের ভরে ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চ’লে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে; এই জল ভালো লাগে;—নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে—বনের ভিতরে বার বার উড়ে যায়,—তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে আমার দেহের ’পরে আমার চোখের ’পরে ধানের আবেশে ঝ’রে পড়ে;—যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ, যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিম গান শোনা যায়, বনের কিনারে ঝরে যেই ধান বুকে ক’রে শান্ত শালি-ক্ষুদ, তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোঁটের ’পরে—চোখের পাতায়— আমার চুলের ’পরে;—অপরাহ্ণে রাঙা রোদ সবুজ আতায় রেখেছে নরম হাত যেন তার—ঢালিছে বুকের থেকে দুধ।
জীবনানন্দ দাশ
এই ডাঙা ছেড়ে হায় জীবনানন্দ দাশ এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে। বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে: ছড়ায়ে র’য়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রাণে;— তাদের উপেক্ষা ক’রে কে যাবে বিদেশে বল—আমি কোনো-মতে বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে—উটির পর্বতে যাব নাকো;—দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে কোন্ দেশে,—কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে বিনুনি খসায়ে ব’সে থাকিবার স্বপ্ন আনে;—পৃথিবীর পথে যাব নাকো:অশ্বত্থের ঝরাপাতা ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর, যখন এ-দু’-পহরে কেউ নাই কোনো দিকে—পাখিটিও নাই, অবিরল ঘাস শুধু, ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ’পর, খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দ’-একটা বিষণ্ণ চড়াই, অশ্বত্থের পাতাগুলো পড়ে আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর; এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই।
জীবনানন্দ দাশ
এই পৃথিবীতে আমি অবসর জীবনানন্দ দাশ এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি—আমি হৃষ্ট কবি আমি এক;—ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে; ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে—ঘাসের আঁচলে ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি;—দেখেছি কিশোরী এসে হলুদ করবী ছিঁড়ে নেয়—বুকে তার লাল-পেড়ে ভিজে শাড়ি করুণ শঙ্খের মতো ছবি ফুটাতেছে;—ভোরের আকাশখানা রাজহাঁস ভ’রে গেছে নব কোলাহলে নব নব সূচনার; নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে—তবু কথা বলে, তবু জানি তার কথা কুয়াশায় ফুরায় না—কেউ যেন শুনিতেছে সবি কোন্ রাঙা শাটিনের মেঘে ব’সে—অথবা শোনে না কেউ, শূন্য কুয়াশায় মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাব আমিও এমন; তবু আজ সবুজ ঘাসের ’পরে ব’সে থাকি; ভালোবাসি; প্রেমের আশায় পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে থাকি চুপে; কাঁটাবহরের ফল করি আহরণ: কারে যেন এইগুলো দেব আমি; মৃদু, ঘাসে একা একা ব’সে থাকা যায় এই সব সাধ নিয়ে; যখন আসিবে ঘুম তারপর, ঘুমাব তখন।
জীবনানন্দ দাশ
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে জীবনানন্দ দাশ এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে—সব চেয়ে সুন্দর করুণ: সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ; সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে,—সেখানে বরুণ কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল; সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল, সেইখানে লক্ষ্মীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ; সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর; সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে; সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর— শঙ্খমালা নাম তার: এ-বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো—বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর, তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
জীবনানন্দ দাশ
এই সব ভালো লাগে জীবনানন্দ দাশ (এই সব ভালো লাগে): জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল― এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল পৃথিবীর সব চেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে; পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টস্‌টসে ভিজে জামরুল, নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর; তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে, মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়; তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসে নি শাখায়; পৃথিবীও নাই আর;―দাঁড়কাক একা একা সারারাত জাগে; ‘কি বা, হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।’
জীবনানন্দ দাশ
একদিন এই দেহ ঘাস থেকে জীবনানন্দ দাশ একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলার জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিল দেহ একদিন; বাংলার পথে পথে হেঁটেছিল গাংচিল শালিখের মতন স্বাধীন; বাংলার জল দিয়ে ধুয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার; একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চ’লে আসে অন্ধকার বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে—নীল ধোঁয়া নরম মলিন বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ; ফেনসা ভাতের গন্ধে আমমুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার বার; এই সব দেখেছিল; রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে, শিখেছিল সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে; তারপর বেত বনে, জোনাকি ঝিঁঝিঁর পথে হিজল আমের অন্ধকারে ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে ক’রে,—রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে— ঘমন্ত কন্যারে সেই—জাগাতে যায় নি আর—হয়তো সে কন্যার হৃদয় শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো—ঘুম তবু ভাঙিবার নয়৷
জীবনানন্দ দাশ
একদিন কুয়াশার এই মাঠে জীবনানন্দ দাশ একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি; হৃদয়ের পথ-চলা শেষ হল সেই দিন—গিয়েছে সে শান্ত হিম ঘরে, অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল—পৃথিবীর এই মাঠখানি ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন; এ মাঠের কয়েকটা শালিখের তরে আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে র’ব কিছু, কাল অন্ধকার বিছানার কোলে, আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায় ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজো চ’লে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে? ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায় সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে, মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে— কত দূরে যায়, আহা,... অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জালে মধুর চাকের নিচে—মাছিগুলো উড়ে যায় ... ঝ’রে পড়ে... ম’রে থাকে ঘাসে—
জীবনানন্দ দাশ
একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে জীবনানন্দ দাশ একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে বিশীর্ণ বটের নিচে শ‍ুয়ে র’ব;—পশমের মতো লাল ফল ঝরিবে বিজন ঘাসে,—বাঁকা চাঁদ জেগে র’বে,—নদীটির জল বাঙালী মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে—তারপর যেই ভাঙা ঘাটে র‍ূপসীরা আজ আর আসে নাকো, পাট শ‍ুধু পচে অবিরল, সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল কাঁদিবে সে সারা রাত,—দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়ে রেখেছে চিতা: বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প—ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে; চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি—শাদা শাঁখা—বাংলার ঘাস আকন্দ বাসকলতা-ঘেরা এক নীল মঠ—আপনার মনে ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;—চারিদিকে এই সব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস—
জীবনানন্দ দাশ
একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফলিয়াছি জীবনানন্দ দাশ একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফলিয়াছি; আমার শরীর নরম ঘাসের পথে হাঁটিয়াছে; বসিয়াছে ঘাসে দেখিয়াছে নক্ষত্রেরা জোনাকিপোকার মতো কৌতুকের অমেয় আকাশে খেলা করে; নদীর জলের গন্ধে ভ’রে যায় ভিজে স্নিগ্ধ তীর অন্ধকারে; পথে পথে শব্দ পাই কাহাদের নরম শাড়ির, ম্লান চুল দেখা যায়; সান্ত্বনার কথা নিয়ে কারা কাছে আসে— ধূসর কড়ির মতো হাতগুলো—নগ্ন হাত সন্ধ্যার বাতাসে দেখা যায়; হলুদ ঘাসের কাছে মরা হিম প্রজাপতিটির সুন্দর করুণ পাখা প’ড়ে আছে—দেখি আমি; চুপে থেমে থাকি; আকাশে কমলা রঙ্ ফুটে ওঠে সন্ধ্যায়—কাকগুলো নীল মনে হয়; অনেক লোকের ভিড়ে ডুবে যাই—কথা কই—হাতে হাত রাখি; করুণ বিষণ্ন চুলে কার যেন কোথাকার গভীর বিস্ময় লুকায়ে রয়েছে বুঝি;... নক্ষত্রের নিচে আমি ঘুমাই একাকী; পেঁচার ধূসর ডানা সারারাত জোনাকির সাথে কথা কয়।
জীবনানন্দ দাশ
একদিন যদি আমি জীবনানন্দ দাশ একদিন যদি আমি কোনো দূর মান্দ্রাজের সমুদ্রের জলে ফেনার মতন ভাসি শীত রাতে—আসি নাকো তোমাদের মাঝে ফিরে আর—লিচুর পাতার ’পরে বহুদিন সাঁঝে যেই পথে আসা-যাওয়া করিয়াছি,—একদিন নক্ষত্রের তলে কয়েকটা নাটাফল তুলে নিয়ে আনারসী শাড়ির আঁচলে ফিঙার মতন তুমি লঘু চোখে চ’লে যাও জীবনের কাজে, এই শুধু … বেজির পায়ের শব্দ পাতার উপরে যদি বাজে সারারাত … ডানার অস্পষ্ট ছায়া বাদুড়ের ক্লান্ত হয়ে চলে যদি সে-পাতার ’পরে,—শেষ রাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ—ধূসর চিবুক, বাম হাত চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে, তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ, তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে—সে-হার ফিরায়ে দিয়ে দিতে যখন কে এক ছায়া এসেছিল … দরজায় করে নি আঘাত।
জীবনানন্দ দাশ
এখানে আকাশ নীল জীবনানন্দ দাশ এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন; আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;—বার বার রোদ তার সুচিক্কণ চুল কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়;—দহে বিলে চঞ্চল আঙুল বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন, ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ; মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল, কবেকার কোকিলের, জান কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়, লিখিতেছিলেন ব’সে দু’-পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল, কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়—থেমে থেমে যায়;— অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধান ক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায় কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল।
জীবনানন্দ দাশ
এখানে ঘুঘুর ডাকে জীবনানন্দ দাশ এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্ণে শান্তি আসে মানুষের মনে; এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে; জামের আড়ালে সেই বউকথাকওটিরে যদি ফেল দেখে একবার,—একবার দু’-পহর অপরাহ্ণে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে ধরা দাও,—তাহ’লে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে; মৌরির গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে র’ব আমি;—চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে; উঠানে কে রূপবতী খেলা করে—ছড়ায়ে দিতেছে বুঝি ধান শালিখেরে; ঘাস থেকে ঘাসে ঘাসে খুঁটে খুঁটে খেতেছে সে তাই; হলুদ নরম পায়ে খয়েরী শালিখগুলো ডলিছে উঠান; চেয়ে দেখ সুন্দরীরে: গোরোচনা রূপ নিয়ে এসেছে কি রাই! নীলনদে—গাঢ় রৌদ্রে—কবে আমি দেখিয়াছি—করেছিল স্নান—
জীবনানন্দ দাশ
এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় জীবনানন্দ দাশ এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায়—সন্ধ্যায় ঘুমায় নীরবে মাটির ভিটের ’পরে—লেগে থাকে অন্ধকার ধুলোর আঘ্রাণ তাহাদের চোখে-মুখে;—কদমের ডালে পেঁচা গেয়ে যায় গান; মনে হয় এক দিন পৃথিবীতে হয়তো এ-জ্যোৎস্না শুধু র’বে, এই শীত র’বে শুধু; রাত্রি ভ’রে এই লক্ষ্মীপেঁচা কথা ক’বে— কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান সাপমাসী পোকাটিরে...সেই দিন আঁধারে উঠিবে ন’ড়ে ধান ইঁদুরের ঠোঁটে-চোখে;—বাদুড়ের কালো ডানা করমচা-পল্লবে কুয়াশারে নিঙড়ায়ে উড়ে যাবে আরো দূর নীল কুয়াশায়, কেউ তাহা দেখিবে না;—সেদিন এ-পাড়াগাঁর পথের বিস্ময় দেখিতে পাব না আর—ঘুমায়ে রহিবে সব:যেমন ঘুমায় আজ রাতে মৃত যারা; যেমন হতেছে ঘুমে ক্ষয় অশ্বত্থ ঝাউয়ের পাতা চুপে চুপে আজ রাতে, হায়; যেমন ঘুমায় মৃতা,—তাহার বুকের শাড়ি যেমন ঘুমায়।
জীবনানন্দ দাশ
কখন সোনার রোদ নিভে গেছে জীবনানন্দ দাশ কখন সোনার রোদ নিভে গেছে—অবিরল শুপুরির সারি আঁধারে যেতেছে ডুবে—প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ-অন্ধকারে ফেলিতেছে শ্বাস; কোন চৈত্রে চ’লে গেছে সেই মেয়ে—আসিবে না, ক’রে গেছে আড়ি: ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে—তাহার শরীর থেকে শ্বাস ঝ’রে গেছে ব’লে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ, কোথাও সে নাই আর—পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি? এই মাঠে—এই ঘাসে—ফল্‌সা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে আজো তার; যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক—দুপুরের রোদে সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি—অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে, তাহার দু’এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে পৃথিবীর রাঙা রোদ চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে— জানি সে আমার কাছে আছে আজো—আজো সে আমার কাছে আছে!
জীবনানন্দ দাশ
কত দিন তুমি আর আমি জীবনানন্দ দাশ কত দিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে;—সন্ধ্যায় ধূসর সজল মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে—বাদুড় কেবল করিতেছে আসা-যাওয়া আকাশের মৃদু পথে;—ছিন্ন ভিজে খড় বুকে নিয়ে সনকার মতো যেন প’ড়ে আছে নরম প্রান্তর; বাঁকা চাঁদ চেয়ে আছে;—কুয়াশায় গা ভাসায়ে দেয় অবিরল নিঃশব্দ গুবরে-পোকা—সাপমাসী—ধানী শ্যামাপোকাদের দল; দিকে দিকে চাল-ধোয়া গন্ধ মৃদু—ধূসর শাড়ির ক্ষীণ স্বর শোনা যায়;—মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব বেদনার গন্ধ ভাসে;—খড়ের চালের নিচে তুমি আর আমি কত দিন মলিন আলোয় ব’সে দেখেছি বুঝেছি এই সব; সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি খড়ের চালের নিচে মুখোমুখি বসে থেকে তুমি আর আমি ধূসর আলোয় ব’সে কত দিন দেখেছি বুঝেছি এই সব।
জীবনানন্দ দাশ
কত দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে জীবনানন্দ দাশ কত দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দু’জনে; আকাশপ্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস সাজায়েছে,—মাঠ থেকে গাজন গানের ম্লান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস ভেসে আসে;—ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনে আকন্দ বনের দিকে;—একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ দু’মুহূর্ত ভ’রে রাখে—তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাস প’ড়ে থাকে; লক্ষ্মীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু, উড়ে চলে বনে আধ-ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কত দিন তুমি হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো বসেছ আমার কাছে এইখানে—আসিয়াছে শটিবন চুমি গভীর আঁধার আরো—দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত আসা-যাওয়া আমরা দু’জনে ব’সে—বলিয়াছি ছেঁড়াফাঁড়া কত মাঠ ও চাঁদের কথা:ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছ তো।
জীবনানন্দ দাশ
কত ভোরে জীবনানন্দ দাশ কত ভোরে—দু’-পহরে—সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন বাতাসে কাঁপিছে ধীরে;—খাঁচার শুকের মতো গাহিতেছে গান কোন এক রাজকন্যা—পরনে ঘাসের শাড়ি—কালো চুল ধান বাংলার শালিধান—আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ, হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার—ঘুম নাই, নাইকো মরণ তার আর কোনোদিন—পালঙ্কে সে শোয় নাকো, হয় নাকো ম্লান, লক্ষ্মীপেঁচা শ্যামা আর শালিখের গানে তারে জাগিতেছে প্রাণ সারাদিন—সারারাত বুকে ক’রে আছে তার শুপুরির বন; সকালে কাকের ডাকে আলো আসে, চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক সবুজ জঙ্গল ছেয়ে শুপুরির—শ্রীমন্তও দেখেছে এমন: যখন ময়ূরপঙ্খী ভোরের সিন্ধুর মেঘে হয়েছে অবাক, সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার শুপুরির বন দেখিয়াছে—অকস্মাৎ গাঢ় নীল; করুণ কাকের ক্লান্ত ডাক শুনিয়াছে—সে কত শতাব্দী আগে ডেকেছিল তাহারা যখন।
জীবনানন্দ দাশ
কোথাও চলিয়া যাব একদিন জীবনানন্দ দাশ কোথাও চলিয়া যাব একদিন;—তারপর রাত্রির আকাশ অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি; জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস বুকে নিয়ে তাহাদের;—জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে— কাঁঠাল শাখার থেকে নামি পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী ধানী শাল পশমিনা বুকে তার —শরতের রোদের বিলাস কতো কাল নিঙড়াবে;—আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু; আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু মুখে গুজে পড়ে রবে—আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি; মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু—
জীবনানন্দ দাশ
কোথাও দেখি নি জীবনানন্দ দাশ কোথাও দেখি নি, আহা, এমন বিজন ঘাস—প্রান্তরের পারে নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে—নীল বুকে আছে তাহাদের গঙ্গাফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের, হিজলের ক্লান্ত পাতা—বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে তাহাদের শ্যাম বুকে;—পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে বেতের নরম ফল, নাটাফল খেতে আসে, ধুন্দুল বীজের খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে,—বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের শালিখ খঞ্জনা তাহা;—লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারে নরম কান্তারে এই পাড়াগাঁর বুকে শ‍ুয়ে সে কোন দিনের কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শ‍ুকায় নি, মজে নি আকাশ, বল্লাল সেনের ঘোড়া—ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের শব্দ হ’ত এই পথে—আরো আগে রাজপুত্র কত দিন রাশ টেনে টেনে এই পথে—কি যেন খুঁজেছে, আহা, হয়েছে উদাস; আজ আর খোঁজাখুঁজি নাই কিছু—নাটাফলে মিটিতেছে আশ—
জীবনানন্দ দাশ
কোথাও মঠের কাছে জীবনানন্দ দাশ কোথাও মঠের কাছে—যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে শ্যাওলায়—অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর, পাশে দীঘি মজে আছে—রূপালি মাছের কণ্ঠে কামনার স্বর যেইখানে পাটরানী আর তার রূপসী সখীরা শুনিয়াছে বহু—বহু দিন আগে;—যেইখানে শঙ্খমালা কাঁথা বুনিয়াছে সে কত শতাব্দী আগে মাছরাঙা-ঝিলমিল;—কড়ি-খেলা ঘর; কোন্ যেন কুহকীর ঝাড়ফুঁকে ডুবে গেছে সব তারপর; একদিন আমি যাব দু’-পহরে সেই দূর প্রান্তরের কাছে, সেখানে মানুষে কেউ যায় নাকো—দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা বেতের বনের ফাঁকে,—জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায় রূপসী মৃগীর মুখে দেখা যায়,—শাদা ভাঁটপুষ্পের তোড়া আলোকলতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণ ফুল বাসকের গায়; তবুও সেখানে আমি নিয়ে যাব এক দিন পাট্‌কিলে ঘোড়া, যার রূপ জন্মে জন্মে কাঁদায়েছে আমি তারে খুঁজিব সেথায়৷
জীবনানন্দ দাশ
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি জীবনানন্দ দাশ কোনোদিন দেখিব না তারে আমি; হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান সারারাত,—তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে—বেণুবনে তাহার সন্ধান পাব নাকো: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনের সাথে, সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না—আসিবে না কখনো প্রভাতে, যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান, যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান, ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে;—এইখানে ধুন্দুল লতাতে জোনাকি আসিবে শুধু; ঝিঁঝিঁ শব্দ সারারাত কথা ক’বে ঘাসে আর ঘাসে; বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে; প্রতিটি নক্ষত্র তার স্থান খুঁজে জেগে র’বে প্রতিটির পাশে নীরব ধূসর কণা লেগে র’বে তুচ্ছ অণুকণাটির শ্বাসে অন্ধকারে;—তুমি, সখি, চ’লে গেলে দূরে তবু;—হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে: আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
জীবনানন্দ দাশ
খুঁজে তারে মর মিছে জীবনানন্দ দাশ খুঁজে তারে মর মিছে—পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর; রয়েছে অনেক কাক এ-উঠানে—তব, সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক নাই আর;—অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক দাঁড়কাক দেখা যেত দিন রাত,—সে আমার ছেলেবেলাকার কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার: রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক,— এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হ’ল তার কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে ক’রে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস, সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্লান চুল, ভিজে শাদা হাত সেই সব নোনা গাছ, করমচা, শামুক, গুগলি, কচি তালশাঁস, সেই সব ভিজে ধূলো, বেলকুঁড়ি-ছাওয়া পথ—ধোঁয়াওঠা ভাত, কোথায় গিয়েছে সব?—অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ ভোর রাতে—নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!
জীবনানন্দ দাশ
গোলপাতা ছাউনির বুক জীবনানন্দ দাশ গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায় উড়ে যায়—মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে; পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার বার চায় যে জড়াতে করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়; এক-একটি ইঁট ধ্বসে—ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায় ভাঙা ঘাটলায় এই—আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে বিনুনি খসায় নাকো—শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে; কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়; ডাইনীর মতো হাত তুলে তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো,—বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে; পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নাই আমি, হায়, এমন বিজন শাদা পথ—সোঁদা পথ—বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে চ’লে গেছে—শ্মশানের পায়ে বুঝি;—সন্ধ্যা আসে সহসা কখন; সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম—নিম—নিম কার্তিকের চাঁদে।
জীবনানন্দ দাশ
ঘাসের বুকের থেকে কবে জীবনানন্দ দাশ ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর— সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে—তাই নীলাকাশ মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়;—পথে পথে তাই এই ঘাস জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়;—মউমাছিদের যেন নীড় এই ঘাস;—যত দূর যাই আমি আরো যত দূর পৃথিবীর নরম পায়ের তলে যেন কত কুমারীর বুকের নিঃশ্বাস কথা কয়—তাহাদের শান্ত হাত খেলা করে—তাদের খোঁপার এলো ফাঁস খুলে যায়—ধূসর শাড়ির গন্ধে আসে তারা—অনেক নিবিড় পুরোনো প্রাণের কথা কয়ে যায়—হৃদয়ের বেদনার কথা— সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা—মাঠের চাঁদের গল্প করে— আকাশের নক্ষত্রের কথা কয়;—শিশিরের শীত সরলতা তাহাদের ভালো লাগে,—কুয়াশারে ভালো লাগে চোখের উপরে; গরম বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে; শীত রাতে—পেঁচার নম্রতা; ভালো লাগে এই যে অশ্বত্থপাতা আমপাতা সারা রাত ঝরে।
জীবনানন্দ দাশ
ঘাসের ভিতরে যেই চড়ায়ের জীবনানন্দ দাশ ঘাসের ভিতরে যেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে—আমি ভালোবাসি নিস্তব্ধ করুণ মুখ তার এই—কবে যেন ভেঙেছিল—ঢের ধূলো খড় লেগে আছে বুকে তার—বহুক্ষণ চেয়ে থাকি;—তারপর ঘাসের ভিতর শাদা শাদা ধূলোগুলো প’ড়ে আছে, দেখা যায়; খইধান দেখি একরাশি ছড়ায়ে রয়েছে চুপে; নরম বিষণ্ন গন্ধ পুকুরের জল থেকে উঠিতেছে ভাসি; কান পেতে থাক যদি, শোনা যায়, সরপুঁটি চিতলের উদ্ভাসিত স্বর মীনকন্যাদের মতো; সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর দেখা যায়—রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ—রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসী চ’লে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল-ছেলের মতো, রাজার ছেলের মতো মিলে কোন্ এক আকাঙ্ক্ষার উদ্ঘাটনে কত দূরে;—বহুক্ষণ চেয়ে থাকি একা; অপরাহ্ণ এল বুঝি?—রাঙা রৌদ্রে মাছরাঙা উড়ে যায়—ডানা ঝিলমিলে; এখুনি আসিবে সন্ধ্যা,—পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে নদীর নরম মুখ দেখা যাবে—মুখে তার দেহে তার কত মৃদু, রেখা তোমারি মুখের মতো:তবুও তোমার সাথে কোনোদিন হবে নাকো দেখা।
জীবনানন্দ দাশ
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের জীবনানন্দ দাশ ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে; তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা—আমার তরুণ দিন তখনো হয় নি শেষ—সেই ভালো—ঘুম আসে—বাংলার তৃণ আমার বুকের নিচে চোখ বুজে—বাংলার আমের পাতাতে কাঁচপোকা ঘুমায়েছে—আমিও ঘুমায়ে র’ব তাহাদের সাথে, ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে—এই ঘাসে—কথাভাষাহীন আমার প্রাণের গল্প ধীরে ধীরে মুছে যাবে—অনেক নবীন নতুন উৎসব র’বে উজানের—জীবনের মধুর আঘাতে তোমাদের ব্যস্ত মনে;—তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চ’লে যাবে—যখন মানিকমালা ভোরে লাল লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে— যখন হলুদ বোঁটা শেফালীর কোনো এক নরম শরতে ঝরিবে ঘাসের ’পরে,—শালিখ খঞ্জনা আজ কতদূর ওড়ে— কতখানি রোদ—মেঘ—টের পাব শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে৷
জীবনানন্দ দাশ
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন জীবনানন্দ দাশ ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে শিয়রে বৈশাখ মেঘ—শাদা শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড় নদীর ওপার থেকে চেয়ে র’বে—কোনো এক শঙ্খবালিকার ধূসর র‍ূপের কথা মনে হবে—এই আম জামের ছায়াতে কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি—কবে যেন রাখিয়াছে হাতে তার হাত—কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড় ঝ’রে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন—এই পাড়াগাঁর পথে তবু, তিন শো বছর আগে হয়তো বা—আমি তার সাথে কাটায়েছি;—পাঁচ শো বছর আগে হয়তো বা—সাত শো বছর কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে; ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে মাঠে কত বার কুড়ালাম খড়, বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে, ভাসানের গান শ‍ুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হ’ল খড় আর ঘর।
জীবনানন্দ দাশ
জীবন অথবা মৃত্যু চোখে জীবনানন্দ দাশ জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে—আর এই বাংলার ঘাস র’বে বুকে; এই ঘাস: সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়— ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চ’লে যায়— এই ঘাস: এরি নিচে কঙ্কাবতী শঙ্খমালা করিতেছে বাস: তাদের দেহের গন্ধ, চাঁপাফুল মাখা ম্লান চুলের বিন্যাস ঘাস আজো ঢেকে আছে; যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায় কার্তিকের অপরাহ্ণে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চ’লে যায় হাঁস, আমি এ ঘাসের বুকে শ‍ুয়ে থাকি—শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে সোঁদা ধুলো শ‍ুয়ে আছে—কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে ভেরেণ্‍ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে—শাদা স্তন ঝরে করবীর: কোন্ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল, তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে: নরম ব্যাকুল৷
জীবনানন্দ দাশ
তবু তাহা ভুল জানি জীবনানন্দ দাশ তবু তাহা ভুল জানি … রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা; তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ়— আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, আরো ঢের জল, জয় আরো; তোমারো পৃথিবী পথ; নক্ষত্রের সাথে তুমি খেলিতেছ পাশা: শঙ্খমালা নয় শুধু:অনুরাধা রোহিণীরও চাও ভালোবাসা, না জানি সে কত আশা—কত ভালোবাসা তুমি বাসিতে যে পার! এখানে নদীর ধারে বাসমতী ধানগুলো ঝরিছে আবারো; প্রান্তরের কুয়াশায় এইখানে বাদুড়ের যাওয়া আর আসা— এসেছে সন্ধ্যার কাক ঘরে ফিরে;—দাঁড়ায়ে রয়েছে জীর্ণ মঠ; মাঠের আঁধার পথে শিশু কাঁদে—লালপেড়ে পুরোনো শাড়ির ছবিটি মুছিয়া যায় ধীরে ধীরে—কে এসেছে আমার নিকট? ‘কার শিশু? বল তুমি’:শুধালাম; উত্তর দিল না কিছু বট; কেউ নাই কোনোদিকে—মাঠে পথে কুয়াশার ভিড়; তোমারে শুধাই কবি: ‘তুমিও কি জান কিছু, এই শিশুটির।’
জীবনানন্দ দাশ
তুমি কেন বহু দূরে জীবনানন্দ দাশ তুমি কেন বহু দূরে—ঢের দূরে—আরো দূরে—নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ, তুমি কেন কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বল নাকো একটিও কথা; আমরা মিনার গড়ি—ভেঙে পড়ে দু’-দিনেই—স্বপনের ডানা ছিঁড়ে ব্যথা রক্ত হয়ে ঝরে শুধু এইখানে—ক্ষুধা হয়ে ব্যথা দেয়—নীল নাভিশ্বাস ফেনায়ে তুলিছে শুধু পৃথিবীতে পিরামিড্-যুগ থেকে আজো বারোমাস; আমাদের সত্য, আহা, রক্ত হয়ে ঝরে শুধু;—আমাদের প্রাণের মমতা ফড়িঙের ডানা নিয়ে ওড়ে, আহা: চেয়ে দেখে অন্ধকার কঠিন ক্ষমতা ক্ষমাহীন—বার বার পথ আটকায়ে ফেলে—বার বার করে তারে গ্রাস; তারপরে চোখ তুলে দেখি অই কোন্ দূর নক্ষত্রের ক্লান্ত আয়োজন ক্লান্তিরে ভুলিতে বলে—ঘিয়ের সোনার-দীপে লাল নীল শিখা জ্বলিতেছে যেন দূরে রহস্যের কুয়াশায়,— আবার স্বপ্নের গন্ধে মন কেঁদে ওঠে;—তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু, ক্লান্তি রক্তের কণিকা ঝরে শুধু—স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ—নিউসিডিয়ায় বসে দেখেনি মণিকা? স্বপ্ন কি দেখেনি রোম, এশিরিয়া, উজ্জয়িনী, গৌড়-বাংলা, দিল্লী, বেবিলন?
জীবনানন্দ দাশ
তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও―আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরী ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে―একবার―দুইবার―তারপর হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে; দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ―শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে শঙ্খের মতো কাঁদে; সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে, খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন কাহিনীর দেশে― ‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে, কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে― নীরবে পা ধোয় জলে একবার―তারপর দূরে নির‍ুদ্দেশে চ’লে যায় কুয়াশায়,―তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে হারাব না তারে আমি―সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।
জীবনানন্দ দাশ
তোমার বুকের থেকে একদিন জীবনানন্দ দাশ তোমার বুকের থেকে একদিন চ’লে যাবে তোমার সন্তান বাংলার বুকে ছেড়ে চ’লে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে, আকাশের নীলাভ নরম বুকে ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে ডুবে যায়,—কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে দিকে রূপশালী ধান একদিন;—হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান, আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে— হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্ক্ষার—তবুও তো চোখের উপরে নীল মৃত্যু উজাগর—বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ— কখন মরণ আসে কে বা জানে—কালীদহে কখন যে ঝড় কমলের নাল ভাঙে—ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিখের প্রাণ জানি নাকো;—তবু যেন মরি আমি এই মাঠ-ঘাটের ভিতর, কৃষ্ণা যমুনার নয়—যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ লেগে থাকে চোখে মুখে—রূপসী বাংলা যেন বুকের উপর জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।
জীবনানন্দ দাশ
দূর পৃথিবীর গন্ধে জীবনানন্দ দাশ দূর পৃথিবীর গন্ধে ভ’রে ওঠে আমার এ বাঙালীর মন আজ রাতে; একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে অচেনা ঘাসের বুকে আমারে ঘুমায়ে যেতে বলে, তবুও সে ঘাস এই বাংলার অবিরল ঘাসের মতন মউরির মৃদু গন্ধে ভ’রে র’বে;―কিশোরীর স্তন প্রথম জননী হয়ে যেমন ননীর ঢেউয়ে গলে পৃথিবীর সব দেশে―সব চেয়ে ঢের দূর নক্ষত্রের তলে সব পথে এই সব শান্তি আছে: ঘাস―চোখ―শাদা হাত―স্তন― কোথাও আসিবে মৃত্যু―কোথাও সবুজ মৃদু ঘাস আমারে রাখিবে ঢেকে―ভোরে, রাতে, দু’-পহরে পাখির হৃদয় ঘাসের মতন সাধে ছেয়ে র’বে―রাতের আকাশ নক্ষত্রের নীল ফুলে ফুটে র’বে;―বাংলার নক্ষত্র কি নয়? জানি নাকো; তবুও তাদের বুকে স্থির শান্তি―শান্তি লেগে রয়: আকাশের বুকে তারা যেন চোখ―শাদা হাত―যেন স্তন―ঘাস―।